Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
নাঙ্গলকোট রেলপথে কাটা পড়ে এ পর্যন্ত নিহত-৫চলাচলের সড়ক না থাকায় পিতা-পুত্রকে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে

নাঙ্গলকোট রেলপথে কাটা পড়ে এ পর্যন্ত নিহত-৫চলাচলের সড়ক না থাকায় পিতা-পুত্রকে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে

মোঃ বশির আহমেদ নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা:
নাঙ্গলকোটের মক্রবপুর ইউনিয়নের বান্নগর উত্তরপাড়ার ২০টি পরিবারের প্রায় ৫শ মানুষের চলাচলে পাশের ঢাকা-চট্রগ্রাম রেলপথই একমাত্র সড়ক। তাদের চলাচলে কোন সড়ক না থাকায় রেলপথ দিয়ে চলাচল করতে গিয়েই সোমবার সন্ধ্যায় পিতা-পুত্রকে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।  পিতা মাহবুবুল হক (৫০) এবং পুত্র রিসানের (৩) মৃত্যু শোক কোনভাবেই থামছে না। মাহবুবুল হকের বড় ছেলে শাহজালাল পিতা এবং ছোট ভাইয়ের মৃত্যু শোকে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত পরিবারটির বাড়িতে আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসীর ঢল নামতে দেখা যায়। আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসী শোকাহত পরিবারটিকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। নিহত মাহবুবুল হকের স্ত্রী রাশিদা আক্তার (৪০), তিন মেয়ে উম্মে কুলসুম (২৫), রিয়া (৮) ৮ মাসের মেয়ে শিশু সন্তান খাদিজা, ছেলে শাহজালাল (২০), মাহফুজ (১৫), রায়হান (১১) রয়েছে। বড় মেয়ে উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয়েছে। দিনমজুর ও হত-দরিদ্র মাহবুবুল হকের মৃত্যুতে স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের ভরণ-পোষণ, পড়ালেখা এবং তাদের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 
মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে নিহত মাহবুবুল হকের পরিবার এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বান্নগর উত্তর পাড়া গ্রামবাসী  স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট ঢাকা-চট্রগ্রাম রেল পথের পশ্চিমপাশে একটি সড়ক নির্মাণে বার-বার দাবি জানালেও সড়ক নির্মাণ হয়নি। বাড়ি থেকে বের হলেই রেলপথ। তাদের চলাচলে কোন সড়ক না থাকায় গ্রামবাসীকে রেলপথ দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে পিতা-পুত্রসহ এপর্যন্ত মাহবুবুল হকের ভাই মাস্টার সায়েদুল হকের এক শিশুসহ পাঁচ জনকে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগী মারা যাচ্ছে।
মাহবুবুল হকের স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, সোমবার সারাদিন আমার স্বামী লাকড়ি কাটেন। ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে আমার ছেলে রিসান দোকান থেকে খাবার কিনে দেয়ার জন্য কান্না করছিলেন। এসময় আমার স্বামী আমাকে দুপুরের ভাত খাওয়ার জন্য ভাত-তরকারি প্রস্তুত রাখার কথা বলে ছেলের কান্না থামাতে খাবার কিনে দেয়ার জন্য রেলপথ দিয়ে দোকানের দিকে চলে যান। পরে আমার স্বামী এবং ছেলে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে নিহত হওয়ার খবর পাই। 
মাহবুবুল হকের ভাই মাস্টার ছায়েদুল হক বলেন, ধারনা করা হচ্ছে, গত সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৫টার দিকে আমার ভাই মাহবুবুল হক তার ছেলে রিসানকে নিয়ে রেল পথ দিয়ে বাতোড়া রাস্তার মাথার দোকানে অথবা পাশের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। আমার ভাই আগে হাঁটছেন। তার পিছু-পিছু ভাতিজা রিসান হাঁটছেন। হাঁটার এক পর্যায়ে রফিকের চা দোকানের সামনে পৌঁছলে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকাগামী দ্রুতগতির ৭০৩ মহানগর গোধুলী এক্সপ্রেস ট্রেনে আসার আওয়াজ শুনে আমার ভাই পিছনে তাকিয়ে প্রথমে তার ছেলে রিসানকে ট্রেন লাইন থেকে সরাতে চেষ্টা করেন। ছেলেকে সরাতে গেলে ট্রেনের ধাক্কায় ছেলের মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং বাম পা কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই ছেলের মৃত্যু হয়। এসময় ট্রেনটি আমার ভাইয়ের ছিন্ন-বিন্ন দেহ  আরো সামনে নিয়ে ফেলে দেয়। পরে খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন রেল পথে খুঁজে-খুঁজে ভইয়ের ছিন্ন-বিন্ন দেহ এবং ছেলে রিসানের লাশ উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে লাকসাম জিআরপি থানা পুলিশ ও নাঙ্গলকোট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশ উদ্ধার করে।
মাহবুবুল হকের ছেলে নাঙ্গলকোট এ আর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান (১৫)  বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যয় রেল পথে আমার আব্বুর লুঙ্গি এবং চাদর পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত বাড়ি আসি। বাড়ি এসে আব্বুর মোবাইল ফোনে ফোন দেই। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এতে আব্বুর মৃত্যু নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। পরে রেল পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে প্রথমে ছোট ভাই রিসানের মাথা থেতলানো এবং বাম পা কাটা অবস্থায় লাশ পড়ে দেখতে দেখি। পরে আরো সামনে এগিয়ে বাবার ছিন্ন-বিন্ন লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাহফুজ জানান, আব্বু আমাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি ছিলেন। বর্তমানে আব্বুর মৃত্যুতে আমাদেরকে পথে বসতে হবে।
নিহত মাহবুবুল হকের ভাই মাস্টার সায়েদুল হক, হিরণ মিয়াসহ এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার মক্রবপুর ইউনিয়নের বান্নগর উত্তর পাড়ার পশ্চিমপাশের ২০টি পরিবারের প্রায় ৫শ মানুষের ঢাকা-চট্রগ্রাম রেলপথ ছাড়া চলাচলের বিকল্প কোন সড়ক নেই। তাদেরকে প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে রেলপথ দিয়ে পাশের দোকানপাট, মক্রবপুর বাজার হয়ে নাঙ্গলকোট উপজেলা সদর এবং লাকসাম হয়ে ঢাকা, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় চলাচল করতে হয়। এছাড়া ছোট-ছোট কোমলমতি শিশুদেরকে রেলপথ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। গ্রামবাসী ঢাকা-চট্রগ্রাম ডাবল লাইন রেলপথের মাঝে ধান, গম, ভুট্রা খড় এবং লাড়কি শুকিয়ে থাকেন। তারা রেলপথ দিয়ে মোটরসাইকেল এবং সাইকেল পার করেন। এছাড়া হেসাখাল-মক্রবপুর সড়কের বান্ননগর উত্তর পাড়ার বাতোড়া সড়কের মাথায় একটি অরক্ষিত রেল ক্রসিং দিয়ে ছোট-বড় যানবাহনসহ এলাকাবাসী নিয়মিত ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াত করেন। রেল ক্রসিং-এ কোন গেটম্যান নেই।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর এই ঝুঁকিপূর্ণ রেল পথে মাহবুবুল হকের ভাই মাস্টার ছায়েদুল হকের ২ বছরের শিশু আনাছ ইবনে সাঈদ ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। এছাড়া নিহত মাহবুবল হকের জেঠা হোসেন আহম্মদের মেয়ে এবং একই গ্রামের মাওলানা আবদুর রশিদের মেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। 
এলাকাবাসী  বান্নগর এলানিয়া সড়ক থেকে মক্রবপুর-হেসাখাল সড়কের বাতোড়া রাস্তার মাথা পর্যন্ত রেল পথের উভয়পাশে লোহার বেষ্টনী দিয়ে মানুষের চলাচলের জন্য নিরাপদ সড়ক নির্মাণ এবং বাতাড়ো রাস্তার মাথায় রেল ক্রসিংএ গেট ম্যান নিয়োগের দাবি জানান।নিহত দিনমজুর ও হত-দরিদ্র মাহবুবুল হক  স্ত্রী রাশেদা বেগম, ৩মেয়ে এবং ৪ চার ছেলে নিয়ে চরম আর্থিক কষ্টে জীবন-যাপন করছিলেন। দো-চালা টিনের ঘরের দরজা-জানালা নেই। একটি ঘরেই গাদাগাদি করে পুরো পরিবার বসবাস করেন। বড় মেয়ে উম্মে কুলসুমকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে শাহজালাল (২০) টুক-টাক কাজ করে যা আয় করেন। তা দিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। এছাড়া মাহবুবুল হকের ভাইয়েরা তাদের হতদরিদ্র ভাইয়ের সহযোগিতায়ও মাঝে-মাঝে এগিয়ে আসেন। মাহবুবল হকের মেঝো ছেলে মাহফুজ নাঙ্গলকোট এ আর উচ্চ বিদ্যালয় নবম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। আরেক ছেলে রায়হান স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেনীতে লেখাপড়া করছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম মাহবুবুল হকের মৃত্যুতে পরিবারটি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। বর্তমানে পরিবারটির খাওয়া-পরা এবং ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মাহবুবুল হকের ছেলে মাহফুজুর রহমান তাদের পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার  দাবি জানান। 
গত সোমবার রাত ১১টায় পিতা-পুত্রের জানাযার নামাজে মক্রবপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা চৌধুরী মুকুল পরিবারটিকে ঘর তৈরীতে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম ছুপু পরিবারটির আর্থিক সহায়তায় ২০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। 
উপজেলা নির্বাহী অফিসার লামইয়া সাইফুল বলেন, পরিবারটিকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য কোন ফান্ড নেই। তারপরও তাদেরকে সহযোগিতা করা যায় কিনা আমি বিষয়টি বিবেচনা করবো। সড়ক নির্মাণ বিষয়ে তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণ সময়সাপেক্ষ এবং জটিল প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে এল জি ই ডিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে বসতে হবে। তিনি আরো বলেন, রেলপথ দিয়ে চলাচলের কোন সুযোগ নেই। আমরা এটাকে সু-রক্ষিত করে দেব।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply