অনলাইন ডেস্ক:
কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে চরাঞ্চল ও নিচু এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করেছে, ভাঙন বেড়েছে নদ-নদীতে।
এ পরিস্থিতিতে দেশের বেশ কিছু স্থানে আকস্মিক বন্যা হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
গতকালের নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের নদীর পানি আগামী তিন দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। পদ্মা নদীর পানি আগামী দুই দিন পর্যন্ত বাড়তে পারে। সুরমা ব্যতীত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী তিন দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাণিতিক মডেলের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা প্রদেশের স্থানগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এর ফলে এই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
তবে আগামী তিন দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টিপাত কমতে পারে বলে বলা হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা জানান, বর্তমানে যেভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা আরো দুই দিন থাকতে পারে। এরপর বৃষ্টিপাত কিছুটা কমতে পারে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় এবং রংপুর ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে কক্সবাজারে, ১১০ মিলিমিটার।
এদিকে গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে (হার্ড পয়েন্টে) পানি ৪৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১.৪১ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার চরাঞ্চল ও নদীতীরবর্তী নিম্ন এলাকাগুলো প্লাবিত হতে শুরু করেছে, দেখা দিয়েছে ভাঙন। এরই মধ্যে জেলার সদর, চৌহালী, শাহজাদপুর ও কাজিপুর উপজেলার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, টানা বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে কয়েক দিন ধরেই যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী কয়েক দিন পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের পানি বাড়ায় বেশ কিছু চরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়ছে নদীভাঙন। গতকাল বিকেলে তিস্তার পানি বিপদসীমার মাত্র ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলা ও তিস্তা অববাহিকার ৫০টি চরের নিচু এলাকা দুই দিন ধরে প্লাবিত রয়েছে। এসব এলাকার পাট, ভুট্টা, আউশ ধান, বীজতলা ও সবজিক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগব্যবস্থা।
সদর উপজেলার হলোখানা ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন জানান, সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত তিন দিনে এখানে ২০টি পরিবার ভিটা হারিয়েছে। বিকল্প বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, মধ্য-জুলাইয়ের আগে বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। যেসব এলাকায় নদীভাঙন চলছে তা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি ও স্রোতের তীব্রতা বাড়ছে। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ১৮ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার এক মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, এভাবে পানি বাড়তে থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানির স্তর বিপদসীমা অতিক্রম করবে। এদিকে পদ্মায় পানি বেড়ে গোয়ালন্দ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলাচলকারী ফেরিগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হালুয়াঘাট পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মোট ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সাত হাজার ৫০০ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলায় ৩২০ হেক্টর রোপা আমন ধানের বীজতলা এবং ১১৫ হেক্টর জমির সবজিক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। ডুবে গেছে ৪৫০টি পুকুর এবং ২০টি মুরগির খামার। হালুয়াঘাট পৌর শহরে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষকে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের গ্রামগুলোতে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে গ্রামীণ বসতি, মৎস্য খামার ও ফসলের ক্ষেত। কোটি কোটি টাকার মাছ ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে রাস্তা, পুকুরের মাছ, ফসলের ক্ষেত, তিন শতাধিক ঘরবাড়ি।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর, হাতিবান্ধা ও ধানশাইল ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিন দিন ধরে এসব এলাকার লোকজন বিপাকে থাকলেও সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ তৎপরতা নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের পাশে দাঁড়াননি। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে ৫০টি পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ত্রাণ বলতে এ পর্যন্তই। সবাই শুধু পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
পাহাড়ি ঢলে নালিতাবাড়ী উপজেলায় ৩০০ হেক্টর জমির আউশ ধান ও ১০০ হেক্টর জমির আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে এবং এক হাজার ১১৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ভোগাই নদীর তীর রক্ষা বাঁধের পাঁচটি পয়েন্টের প্রায় সাত কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।