দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে ১৪ জনকে আটক করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ ও মজুদ করা প্রায় এক হাজার ২০০ ট্রেনের টিকিট উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক টিকিট কালোবাজারির মাধ্যমে সংগ্রহ করত। এরপর বেশি দামে বিক্রি করত।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। আজ শুক্রবার র্যাবের কারওয়ান বাজার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্র- উত্তম ও সেলিম সিন্ডিকেটের ১৪ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ও ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ নামের দুটি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে।
দীর্ঘ এই ভ্রমণে নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রার জন্য এ রুটে ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হয়।
টিকিটের চাহিদা বেশি থাকায় টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায়। অনলাইনে বা কাউন্টারে বিক্রি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় এই রুটের ট্রেনের টিকিট। কিন্তু কালোবাজারিদের কাছে দু-তিন গুণ দামে টিকিট বিক্রি হতে দেখা যায়।
চাহিদা অনুযায়ী টিকেট না পাওয়ার এবং টিকেট কালোবাজারী কর্তৃক অধিক মূল্যে টিকিট বিক্রির বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়।
তিনি বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ ও কালোবাজারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৩-এর একটি দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা মো. সেলিম (৫০), তার প্রধান সহযোগী মো. আনোয়ার হোসেন কাশেম (৬২), অবনী সরকার সুমন (৩৫), মো. হারুন মিয়া (৬০), মো. মান্নান (৫০), মো. আনোয়ার হোসেন ডাবলু (৫০), মো. ফারুক (৬২), মো. শহীদুল ইসলাম বাবু (২২), মো. জুয়েল (২৩), মো. আব্দুর রহিমকে (৩২) প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা উত্তম চন্দ্র দাস (৩০), মো. মোর্শিদ মিয়া ওরফে জাকির (৪৫), আব্দুল আলী (২২) ও মো. জোবায়েরকে (২৫) গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে, কমলাপুর রেলস্টেশনে সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা সেলিম ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা উত্তমের নেতৃত্বে এই চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে মহানগর প্রভাতি, তূর্ণা নিশীথা, চট্টলা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে আসছিল।
এদের মধ্যে সেলিম ও উত্তমের নেতৃত্বে তাদের সহযোগীরা প্রথমত ট্রেনের কাউন্টারে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ যাত্রী, রেলস্টেশনের কুলি, স্টেশনের আশপাশের এলাকার টোকাই, রিকশাওয়ালা ও দিনমজুরদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে থাকে। এই ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে চারটি করে টিকিট সংগ্রহ করার বিনিময়ে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো।
এ ছাড়া কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকিট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীদের টিকিট কাটার সময় প্রদেয় এনআইডি সংগ্রহ করে রাখে। পরবর্তী সময়ে সেগুলো ব্যবহার করে সংরক্ষণকৃত প্রতিটি এনআইডি দ্বারা চারটি করে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করে থাকে। এভাবে তারা প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক টিকিট সংগ্রহ করত।
অনেক ক্ষেত্রে টিকিট কাউন্টারে নিজেরা লাইনে দাঁড়িয়ে এবং কৌশলে লাইনে অপেক্ষমাণ টিকিট প্রত্যাশী সাধারণ যাত্রীদের এনআইডি ব্যবহার করে চারটি টিকিট ক্রয় করে তিনটি টিকিট নিজেরা তার কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনে নিত। এ ছাড়া ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনকে উপলক্ষ করে গ্রেপ্তারকৃতরা রেলস্টেশনে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মচারী এবং অনলাইনে টিকিট কেনার জন্য ব্যবহৃত ভেন্ডার প্রতিষ্ঠান সহজ.কম-এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সার্ভার রুম/আইটি-এর সদস্যদের সহযোগিতায় তাদের কাছে সংরক্ষিত জনসাধারণের এনআইডির তথ্য ব্যবহার করে।
এমনকি সার্ভার ডাউন করে তারা অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করত। পাশাপাশি গ্রেপ্ততারকৃতরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনলাইনে টিকিট কেটে সেগুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করত। গ্রেপ্তারকৃতরা স্টেশনে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করাত। ওই টিকিটের মূল্য কাউন্টারের বুকিং কর্মচারীদের সঙ্গে তারা ভাগ করে নিত। ফলে রেলওয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে গ্রেপ্ততারকৃতরা অবৈধভাবে বিভিন্ন পন্থায় বিপুলসংখ্যক ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করত বলে জানায়।