অনলাইন ডেস্ক:
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে আন্তরিকতা, তার তুলনা হয় না বলে নিজের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিস্তার পানিবণ্টনের বরফ গলাতে শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশ ভোজের এক টেবিলে পাশাপাশি চেয়ারেও বসিয়েছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার সঙ্গে নিজের পরিবারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেও উল্লেখ করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
আত্মজীবনীর চতুর্থ ও শেষ খণ্ড ‘দ্য প্রেসিডেনশিয়াল ইয়ার্স : ২০১২-২০১৭’তে এসব কথা লিখছেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়; যিনি গত বছরের ৩১ আগস্ট মারা যান। গত মঙ্গলবার বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভবনটিতে যেটি সব থেকে সম্মানীয় অতিথিশালা, তাঁর থাকার জন্য সেটিকে সংস্কার করা হয় এবং নতুন করে সেটাকে ঢেলে সাজানো হয়। শেখ হাসিনা সেই অনুরোধ রক্ষা করেন এবং সেখানে আসেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন রাষ্ট্রপতি হননি, তখনো তাঁকে ঢাকায় আসার জন্য যে রকম আমন্ত্রণ শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও ঢাকায় আসার জন্য তেমন আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রণব মুখোপাধ্যায় ঢাকায় গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার ওই সফরে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি নৈশ ভোজের আয়োজন করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেই নৈশ ভোজে শেখ হাসিনার সম্মানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বিশিষ্ট সমাজসেবী, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বরেণ্যরা আমন্ত্রিতছিলেন; যাঁর মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নৈশ ভোজে একটি টেবিল বিশেষভাবে সাজানো হয়, যেটিতে শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাশাপাশি চেয়ারে বসেন। আত্মজীবনীতে প্রণব লিখেছেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জমে থাকা বরফ হাসিনা-মমতার আলোচনার মাধ্যমে গলাতে। তিনি লিখেছেন, ‘মমতার সঙ্গে শেখ হাসিনার যে আন্তরিকতা, যে কথাবার্তা, তার কোনো তুলনা হয় না। সেদিন খুবই ভালো এবং স্বাভাবিকভাবেই সবাই বাংলাতেই কথা বলছিলেন। খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে, খুব সুন্দর আলাপ-আলোচনা হয়েছিল।’
এরপর প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন যে এত সুন্দর আলাপ-আলোচনা, হৃদ্যতার পরিবেশের মধ্যেও তিস্তা নিয়ে যে আলোচনাটা, এত কিছুর পরও সেখানে মমতা তাঁর রাজ্যের স্বার্থে কথা বলে তিনি তাঁর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটাননি।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে নিজের পরিবারের ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শুধু শেখ হাসিনা নন, শেখ হাসিনার পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাঁর বোন শেখ রেহানার সঙ্গেও আমার পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই নির্বাসনের সময় থেকে।’
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে নিজের ঢাকা সফরের প্রসঙ্গে প্রণব লিখেছেন, সেই সফরের আন্তরিকতা তিনি ভুলতে পারবেন না। সেবার তিনি ঢাকায় গিয়ে শ্বশুরবাড়ি নড়াইলের ভদ্রভিলাতেও গিয়েছিলেন।
সে সফরের স্মৃতিচারণা করে প্রণব লিখেছেন, তিনি যখন ঢাকায় গিয়েছিলেন, তখন ঢাকায় আন্দোলন চলছিল, মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের যথাযথ বিচারের জন্য। সেই সময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, কিন্তু তিনি আসতে পারেননি সেই বিক্ষোভের জন্য। সেই বিক্ষোভটাও তিনি স্মরণ করেছেন এবং প্রণব বলেছেন, ‘আমি টিভিতে দেখছিলাম ঢাকায় বসে যে, যাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি।’ কিন্তু তাদের মনস্তত্ত্বটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কেন তারা এ রকমভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বিক্ষোভের মূল দাবিটা ছিল যারা ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’, তাদের যাতে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়।
প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর সব থেকে বড় গুরুত্বপূর্ণ যেটা স্মৃতি সেটা হচ্ছে ২০১৩ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ সফরে যান এবং যে সম্মান পান, তা অতুলীয়। ১৯৭৪ সালের পর তিনি প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি, যিনি বাংলাদেশ সফর করলেন। সেই সফর তিনি ভুলতে পারেননি এ জন্য যে, যখনই তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে নামছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন; মন্ত্রীরা স্বাগত জানিয়েছেন। গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে, ২১টি গান স্যালুট দেওয়া হয়েছে। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে যে তাঁর বিমানের পেছনে পেছনে বেশ কয়েকটা বিমানও এসেছিল। খুব সুন্দর সাজসাজ রব হয়েছিল। সেই জিনিসটা প্রণব মুখোপাধ্যায় কোনো দিন ভুলতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথায় ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এসেছে এবং বাংলাদেশ তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেও স্বীকার করেন।