ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আবারও চলছে জোর আলোচনা। সংগত ও যৌক্তিকভাবে এই ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে কেউ কেউ আইনি প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনও করা হয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে এই আবেদন করা হয়।
১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন ছিল সেটি। সব রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়েছিল।
কিন্তু ১৯৯৮ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট এই সংশোধনীর বৈধতা প্রশ্নে রুল জারি করেন। চূড়ান্ত শুনানির পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। পরের বছরই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিট আবেদনকারীরা। সেই আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে রায় দেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, ‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসপেক্টেভলি (ভবিষ্যতের জন্য) বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো, যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তা আইনসিদ্ধ করে। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—এ ধরনের সনাতনতত্ত্বের ভিত্তিতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বে উল্লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে।
সংক্ষিপ্ত এই রায়ের ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়, তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেন। তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকার বিষয়টি ছিল না।
এমনকি সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসংগতি নিয়ে তখন জোরালো বিতর্ক ওঠে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আইন সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং মৌলিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেওয়ার কারণে বিতর্কিত আইনটি অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং অকার্যকর বলে গণ্য হয়েছে। রায়ে তিনি আরো বলেন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি সংসদের কর্তৃত্বাধীন। সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের একটি যুক্তিসংগত সময়ের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া যেতে পারে এবং এই সময়টি ৪২ দিন হতে পারে। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বাভাবিক এবং সাধারণ কার্যাবলি সম্পাদন করবে।
রায়ে তিনি আরো বলেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত সক ব্যক্তি এবং প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন), বিচারপতি এস কে সিনহা (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন) এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন)।
রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া এ রায় নিয়ে তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীসহ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বেশ কয়েকজন বিচারপতি, আইনজীবী, রাজনীতিক ও বিশিষ্টজন।