অনলাইন ডেস্ক:
সংবাদমাধ্যম এএফপি সম্প্রতি একটি ছবি প্রচার করেছে। ছবিতে দেখা যায় ইসরায়েলের বিমান হামলার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিহত এক নারীর শরীরের নিম্ন অর্ধাংশ। আর মাথাসহ ওপরের অর্ধাংশ ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়া। একটি পা দেখা যাচ্ছে, আঘাতের চিহ্ন, ক্ষতবিক্ষত, পরনের কাপড় ছিন্নভিন্ন। গাজার একজন আতঙ্কিত স্বেচ্ছাসেবক কর্মী মৃতদেহটি উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। সামাজিক মাধ্যমে আরেকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনের একজন প্রতিবাদকারী কিশোরীকে মাটিতে ফেলে ইসরায়েলি এক সেনা তার মাথা ও ঘাড় হাঁটু দ্বারা এমনভাবে চেপে ধরেছে, কিশোরীর মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বের হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে ২০২০ সালের প্রথম দিকে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য স্মরণে আসায় নতুনভাবে সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ হয়েছে—Palestinian Lives Matter.
যেকোনো মূল্যে ধর্মবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে শুধু রক্ষা নয়, লাখ লাখ ফিলিস্তিনবাসীকে চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি থেকে উত্খাত করা হয়েছে। ৭৩ বছর ধরে তারা অধিকারহীন, ভাসমান শরণার্থী, দুধের বাচ্চাসহ নিরপরাধ নারী-শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে কেউ ইট-পাটকেল ছুড়লেই বলা হবে ওরা সবাই সন্ত্রাসী। সুতরাং তাদের হত্যা করা জায়েজ! প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দিকে জাতিসংঘে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিকি হিলি একবার নিরাপত্তা পরিষদে গাজার হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব তুললেন। প্রস্তাবের পক্ষে নিকি হিলির নিজের ভোটটি ছাড়া একটি ভোটও পাননি। ইউরোপের মিত্ররা ভোটদানে বিরত থেকেছে আর ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের বাকিরা সবাই বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। নিকি হিলি তখন হুমকি দিলেন, দেখে নেওয়া হবে। নিরাপত্তা পরিষদে ওই প্রস্তাবের ভোটের ফলাফলে বোঝা যায়, বিশ্বজনমত নির্যাতিত ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে। কিন্তু অর্থ ও অস্ত্র ক্ষমতা, তার সঙ্গে আমেরিকার সমর্থনে যেকোনো মূল্যে আরববিশ্বের রাজতন্ত্রের রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার বদ্ধ ইচ্ছার কাছে মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানবাধিকার ৭৩ বছর ধরে ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে। যুদ্ধেরও একটা সীমা আছে। যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের প্রারম্ভে বলা হয়েছে—Even wars have limit, civilian should never be targetted. কনভেনশনের এক নম্বর রুলস—Prohibit targeting civilian, doing so is a war crime. সুতরাং জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ৭৩ বছর ধরেই এটি চলছে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা ছিল, মুরব্বি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন জো বাইডেনের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ভারসাম্য অবস্থা ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আসলে ৭৩ বছরের ইতিহাসে আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্টই পার্থক্য কিছু ঘটাতে পারেননি। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসে প্রথম প্রথম অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে জুন মাসের ৪ তারিখে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো ভাষণ দিয়ে উপস্থিত প্রায় অর্ধলাখ ছাত্র-শিক্ষকের কাছ থেকে স্ট্যান্ডিং ওবেশন পেয়েছিলেন ওবামা। বলেছিলেন ২০১১ সালের মধ্যে স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে। কিন্তু শুধু ব্যর্থই হয়নি, দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে তিনি ফিলিস্তিন সম্পর্কে একটি কথাও আর বলতেন না। এই লিগ্যাসির সূত্রে ফিলিস্তিনের নারী-শিশু আজ যখন ইসরায়েলি বোমা হামলায় নিহত হচ্ছে, তখন আমেরিকার নতুন প্রশাসনের মুখপাত্র বলছেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষার সংজ্ঞা কী হবে, তা একবারও বলছেন না।
একটু ফিরে দেখি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকৃত নতুন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের মোট আয়তন ছিল ২০ হাজার ৭৭০ বর্গকিলোমিটার আর মোট লোকসংখ্যার শতকরা মাত্র ৩ ভাগ ছিল ইহুদি, বাকি সব আরব। তারপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের এনে এখানে স্থায়ী করার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর রেজল্যুশনে সর্বসম্মতিক্রমে বলা হয়, ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ড সমান দুই ভাগ হবে। আর তাতে সমান আয়তনের দুটি রাষ্ট্র হবে—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। অর্থাৎ ১০ হাজার ৩৮৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রস্তাব ফিলিস্তিনের জন্য গৃহীত হয়। কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে তখন ইসরায়েল এই পুরো এলাকা দখল করে নেয়, যা এখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তারপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেমসহ সম্পূর্ণ পশ্চিম তীর জর্দানের কাছ থেকে এবং গাজা অঞ্চল মিসরের কাছ থেকে ইসরায়েল দখল করে নেয়। এ দুই এলাকা মিলে মোট আয়তন ছয় হাজার ২০ বর্গকিলোমিটার। এই জায়গা যাদের, সেই জর্দান ও মিসর, তারা তো ফেরত পেলই না, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উঠল, এই ছয় হাজার ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে। ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে তার পরোক্ষ প্রতিফলনও ঘটে। সবাই মনে করেন, অসলো চুক্তির পথ ধরে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। কিন্তু এক সময়ে এসে ইসরায়েল অসলো চুক্তির শর্ত ভেঙে, জাতিসংঘের প্রস্তাবকে ছুড়ে ফেলে আলোচ্য ছয় হাজার ২০ বর্গকিলোমিটারের ভেতরে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এই সামান্য জায়গারও অর্ধেকের বেশি দখল করে নেয় এবং ঘোষণা দেয়, এটিও ইসরায়েলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবাই মুখে বলছেন দুই স্বাধীন রাষ্ট্রই সমাধান। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জায়গা আর থাকল কোথায়।
ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারহীনতার কাহিনি অনেক লম্বা। জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবকে পদদলিত করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে ইহুদিদের গোপন সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার মুখে সাড়ে আট লাখ ফিলিস্তিনবাসী ১৯৪৮ সালে চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হলো। বিতাড়িত সেই হতভাগ্য মানুষের উত্তরসূরিরা সংখ্যায় আজ প্রায় ৫০ লাখ, যারা সবাই এখনো শরণার্থী। তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি সব কিছু ইহুদিরা ১৯৪৮ সালে দখল করে নেয়, তার সামান্য অংশও কেউ ফেরত পায়নি। এই বাস্তবতায় বিশ্ববিবেক, জাতিসংঘ, মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনবাসীর আত্মরক্ষার সংজ্ঞা তাহলে কিভাবে নির্ধারণ করবে। ১৯৬৭ সালে দখলকৃত জায়গা ইসরায়েলকে ছেড়ে দিতে হবে—এই মর্মে জাতিসংঘের ২৪২ নম্বর প্রস্তাবসহ প্রায় ডজনখানেক এ রকম প্রস্তাব ইসরায়েল ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আসলে বিশ্বের সব অস্ত্র ব্যবসায়ী, পরাশক্তিসহ পশ্চিমা বিশ্বের শাসক শ্রেণি কেউ এই সমস্যার সমাধান চায় না। কারণ এই সমস্যা জিইয়ে থাকলে সবার অস্ত্র ব্যবসা রমরমা থাকে, তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার অজুহাত পাওয়া যায় এবং মধ্যপ্রাচ্যকে বহু ভাগে বিভক্ত রেখে তেলসম্পদের ওপর ছড়ি ঘোরানো সহজ হয়। ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান যে রকম, তাতে এই সমস্যার সমাধান কবে হবে কেউ তা জানে না। আরববিশ্ব আজ বহু ভাগে বিভক্ত। ওআইসি এবং আরব লীগের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। অমানবিক চিরস্থায়ী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেই ভবিষ্যতেও সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হবে, যে কথা লেখার শুরুতেও একবার বলেছি। কলকাতার একটি বাংলা সিনেমার এক দৃশ্যে দেখা যায়, বয়োবৃদ্ধ এক শ্বশুর প্রিয় পুত্রবধূকে উপদেশ দিচ্ছেন, স্বামীর অত্যাচার ঠেকাতে না পারলেও সব সময় চুপ থাকবে না, মাঝেমধ্যে ফোঁস করে উঠবে। ইসরায়েলের বিশাল সামরিক শক্তির বিপরীতে মাঝেমধ্যে দু-একবার ফোঁস করে উঠলেই ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসে। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, গোলন্দাজ বাহিনী নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করছে। গাজা থেকে যে রকেট হামলা হচ্ছে, তার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ আকাশে থাকতেই ইসরায়েল ধ্বংস করে দিচ্ছে, মাটিতে পড়তে পারছে না। সুতরাং ইসরায়েলের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের শিকার হচ্ছে গাজাবাসী।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সব ধর্ম-বর্ণের শান্তিকামী মানুষ একসঙ্গে ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদ করছে। লন্ডনে বড় মিছিল হয়েছে। সেখানে লেবার দলের সাবেক প্রধান জেরেমি করবিন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন। খোদ আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক দলের বেশ কয়েকজন সদস্য মার্কিন প্রশাসনের কঠিন সমালোচনা ও ইসরায়েলের বর্বরতা তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের প্রতিনিধি আলেকজান্ডার কার্টেজ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক শহরে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সব ধর্ম-বর্ণের জনগণ সম্মিলিত মিছিল করছে। কিন্তু কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে মানুষের একটি অংশ এই সংকটকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। তারা প্রচার করছে, এটি মুসলিম ভার্সেস ইহুদি যুদ্ধ। এ রকম সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে কাজ করবে। এটি মূলত জাতিগত ও ভূ-রাজনৈতিক সংকট। মুসলিম ভার্সেস ইহুদি সংকট হলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র নিশ্চুপ কেন, বরং তারা তো প্রচ্ছন্নভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। সুতরাং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নারী, শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা ও একতরফা ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আমরা সবাই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াব, এই হোক মৌলিক কথা। আমাদের কথা হবে হবে, “ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।”
লেখক : মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.),রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com