অনলাইন ডেস্ক:
শিরোনামে যে টেবিলের কথা উল্লেখ করেছি তা ক্ষমতার টেবিল। আপনারা অনেকেই হয়তো বলবেন, সেটা আবার কী? ক্ষমতার আবার টেবিল হয় নাকি? ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লাঠি-বন্দুক-গোলাবারুদ লাগে, মাস্তান বাহিনী পুষতে হয়, কিন্তু টেবিল? টেবিলের সঙ্গে ক্ষমতার কী সম্পর্ক? টেবিলের কাজ তো হচ্ছে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, তাস-পাশা-ক্যারম-লুডু ইত্যাদি খেলার জন্য, বিভিন্ন সামগ্রী রাখার জন্য, মালিকের মর্জিমতো কাজে লাগা—এগুলোর সঙ্গে ক্ষমতার কী সম্পর্ক? না, আসলেই এগুলোর সঙ্গে ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি যদি আপনাকে আপনার চিন্তাশক্তি আরেকটু প্রসারিত করতে অনুরোধ করি, যদি বলি আপনার বাড়ি থেকে বের হয়ে কাছে-কিনারে কোনো সরকারি-আধাসরকারি-নিমসরকারি, এমনকি কোনো বেসরকারি দপ্তরের বড়কর্তা, মেজোকর্তা, সেজোকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যান বা তাঁদের দর্শনলাভে ব্যর্থ হয়ে কোনো কেরানিপুঙ্গবের টেবিলের সামনে দুই মিনিট অবস্থান করুন, তাহলেই বুঝবেন ক্ষমতা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী।
প্রথমত, কর্তাব্যক্তিটির কামরায় প্রবেশাধিকার লাভ করতেই আপনার ঘাম ছুটে যাবে। কামরাটির দরজা আগলানোর দায়িত্বে নিয়োজিত পিয়ন পদবিধারী ব্যক্তিটির মনোরঞ্জন করতে না পারলে আপনার মিশনের ওখানেই সমাপ্তি। মনোরঞ্জনের কাজটি কিভাবে করতে হবে জানতে চাইছেন? তা ওটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন : আপনাকে অমুক এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন বলে দিলেন একটা গুল ছেড়ে। তবে পরবর্তী পর্যায়ে যদি ধরা পড়ে ওটা শুধু গুল নয়, একেবারে গুলে বকাউলি, তাহলে কিন্তু বড় রকম খবর আছে। তাই ওসব ধান্দাবাজিতে না গিয়ে সবাই যেটা করে—এবং যে পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও তাত্ক্ষণিকভাবে ফলদায়ক—সেটাই অনুসরণ করুন। ওটা হচ্ছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ পদ্ধতি। ওটা প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ যে পিয়ন সাহেব আপনার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টির ঠিকুজি নিচ্ছিল, আর যার সঙ্গে দেখা করতে চান সেই অমাবস্যার চাঁদ ব্যক্তিটি সরকারের কোনো সূর্যসারথির সঙ্গে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা নিয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত, সেই হাইকোর্ট দেখাচ্ছিল আপনাকে, সেই প্রবল প্রতাপশালী পিয়ন হুজুর একেবারে বিনয়ে বৈষ্ণব হয়ে পারলে আপনাকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে যাবে। ওই ‘কড়ি’ বস্তুটির আসলে অসীম ক্ষমতা। সাধে কি আর আমাদের সিলেট অঞ্চলে বলে : টেকার (টাকার) নাম জয়রাম/টেকা থাকলে হকল (সকল) কাম।
যাক, এবার আপনি পৌঁছে গেছেন কর্তাব্যক্তিটির কাছে। তিনি চোখের ইশারায় আপনাকে বসতে বললেন ঠিকই; কিন্তু যে নথিটি তাঁর সামনে খোলা ছিল ওটা থেকে স্বভাবতই মনোযোগ সরালেন না। এটাকে আপনি আপত্তিকর কিছু মনে করবেন না। কারণ আপনি তো আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসেননি। ফলে আপনি অপেক্ষা করবেন কখন ভদ্রলোক ফ্রি হবেন। আর মনে মনে একটা কারণ স্থির করে নেবেন এই বিনা নোটিশে দেখা করতে আসার। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর কোনো জনহিতকর কাজ, যেমন—এলাকার কোনো রাস্তার উন্নয়ন বা বাচ্চাদের স্কুলের সমস্যা, একটা বিগড়ে থাকা টিউবওয়েলের আশু মেরামত ইত্যাদি বলে আলাপের সূত্রপাত করেন দর্শনার্থী। আর তিনি যদি এলাকার একজন রাজনৈতিক নেতা বা মোটামুটি পরিচিত সমাজকর্মী হন, তাহলে এমনভাবে আলাপ জমাতে চাইবেন যেন সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করা তাঁর সামাজিক দায়িত্ব। এ ধরনের আলাপচারিতায় আমাদের দেশে অবশ্যম্ভাবীরূপে রাজনীতি এসে পড়ে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাটি এতে অস্বস্তি বোধ করার কথা। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করেনও। নীতিবাগিশ কর্মকর্তাটি যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলেন : কিছু মনে করবেন না, অফিসে রাজনৈতিক আলোচনা করা অনুচিত। আর আমি একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে পাবলিকলি রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা থেকে সব সময় বিরত থাকি।…
তবে হ্যাঁ, দুঃখজনক হলেও সত্য, মুখে স্বীকার না করলেও সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ এখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এটা সুশাসনের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর তা তাঁরা বুঝেও এই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল কেন যে ভক্ষণ করেছেন বুঝি না। অবশ্য যেসব ইবলিস ফেরেশতা তাদের এই গন্দম ভক্ষণে প্ররোচিত করেছিল তারা কিন্তু যথাসময়ে বিশাল পারিতোষিক বাগিয়ে নিয়েছে। ওই ইবলিসদের অনুসারীরা মনে করেন এই প্রক্রিয়ায় তাঁদের পদায়ন, পদোন্নতি, বিদেশভ্রমণ ইত্যাদি সহজলভ্য হবে, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বড় বড় পদ পাবেন, কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকবেন ইত্যাদি। এর সবই হয়তো ঠিক; কিন্তু প্রশাসনের সবচেয়ে বড় চাহিদা যে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা তার ভিত্তিমূলে যে তাঁরা জেনেশুনে কুঠারাঘাত করছেন তার কী হবে? ‘ফেসলেসনেস অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা প্রশাসনের অবয়বহীনতা বলে তো আর কিছু রইল না। অথচ ব্রিটিশ আমল থেকে যে ‘স্টিলফ্রেম অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নিয়ে এই উপমহাদেশের এত সুনাম সেই স্টিলেও মনে হয় এখন মরচে ধরতে শুরু করেছে। প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ, দলীয়করণ ইত্যাদির সঙ্গে যেসব আনুষঙ্গিক ব্যাধি বিস্তার লাভ করতে থাকে তার মধ্যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বিচারহীনতা অন্যতম। দুর্নীতির ব্যাপারটা সবচেয়ে পীড়াদায়ক এই জন্য যে একজন কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ভালো করেই জানেন, তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে পুকুরচুরি কেন, সাগরচুরি করলেও কেউ তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ ‘তিনি আমাদের লোক’। আর এ ধরনের কর্মকর্তা একটি পুরো ক্যাডারকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এরা হচ্ছে ঝুড়ির সেই একমাত্র পচা আপেল, যার উপস্থিতির কারণে বাকি সব কটি আপেলেও পচন ধরে যায়।
২.
এতক্ষণ এত কথা বলার পরও টেবিলের এপাশ-ওপাশের ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হয়েছে বলে অন্তত আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আরেকটু ঝেড়ে কাশার চেষ্টা করি। যেকোনো দপ্তরে যান শুনবেন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে পাবলিককে সেবাদান করা। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরগুলো। ইদানীং এটা আরো প্রকট হয়েছে একটা স্লোগানের কারণে। কভিড-১৯-এর সংক্রমণ রোধ করতে সারা বিশ্বে কর্তৃপক্ষ মাস্ক পরার ওপর ভীষণ জোর দিচ্ছে। আমাদের দেশেও অফিস-আদালত, দোকানপাট, রাস্তাঘাট যত্রতত্র সবখানে ‘নো মাস্ক-নো সার্ভিস’ (বাংলা করলে দাঁড়ায়, মুখোশ নেই তো সেবা নেই) লেখা স্টিকারে ছেয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলায় যদি কাউকে বলেন, ‘এই তোমার মুখোশ কোথায়’, তাহলে একজন রিকশাওয়ালা-মুটে-মজুর বা কাজের বুয়া হয়তো বুঝবে না, হা করে চেয়ে থাকবে। কিন্তু পরক্ষণে যদি বলেন, ‘মাস্ক না পরে এসেছ কেন’, তাহলে ওই ব্যক্তি হয়তো বলবে, মাস্ক? এইতো সঙ্গে আছে। তয় আগে যেন কী কইলেন মুখোশ, না কী যেন? এটা অনেকটা সেই রিকশাওয়ালাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় যাবে নাকি’ বলার মতো। বেচারা অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা জানিয়ে দিল সে যাবে না। তখন সেই যাত্রী ভদ্রলোক যখন বললেন, ‘যাবে না কেন? খালি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ, অথচ আমাকে ইউনিভার্সিটিতে নামিয়ে দিলে দুটো টাকা তো পেতে’, তখন রিকশাওয়ালার ক্লাসিক জবাব : ইনিভার্সিটি যাইবেন? তো হেইডা তো কইবেন। কী একটা ইংরেজি শব্দ কইলেন হেইডা কি আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ বুঝি?
হাঁ, কথা হচ্ছিল সেবাদান নিয়ে। এই সেবাদানকারীদের কর্মস্থল হচ্ছে সরকারি-আধাসরকারি-নিমসরকারি দপ্তর। বেসরকারি দপ্তর, যেমন এনজিওগুলোও সেবাদান করে। আপাতত আমরা সরকারি সেবাদানকারীদের কোনো একটি দপ্তর একবার ঘুরে আসি। এগুলোতে যে কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সঙ্গে আপনি দেখা করতে যাবেন তিনি যে সব সময় তাঁর সিটে থাকবেন এমন নিশ্চয়তা কেউ আপনাকে দিতে পারবে না। পাকিস্তানি আমলে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিস সম্বন্ধে একটা কথা চাউর ছিল : ওই অফিসে চেয়ারের হেলান দেওয়ার জায়গায় নাকি কোট ঝুলিয়ে রেখে কেউ কেউ দিনের পর দিন অফিস থেকে অনুপস্থিত থাকতেন। এখন অবশ্য পরিস্থিতি এতটা খারাপ নয়। এটা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তবে শুধু অফিস বলে নয়, যেকোনো দপ্তরেই ‘স্যার সিটে নেই’ ভাইরাসটি এখনো কমবেশি সক্রিয় আছে।
যা হোক, ধরা যাক সৌভাগ্যক্রমে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে তাঁর সিটে পেলেন। তিনি তাঁর চেয়ারে বসে আছেন, সামনে একটি টেবিল, যার ওপর নথিপত্র ইত্যাদি আছে। আপনি বসবেন ওই ব্যক্তির মুখোমুখি টেবিলের ওপাশে। এবার আপনাদের দুজনের পরিচয় হচ্ছে : আপনি গ্রহীতা, আর তিনি দাতা। আপনি গ্রহণকারী বা গ্রাহক, আর তিনি প্রদানকারী বা প্রদায়ক। তাঁর যে প্রদান করার ক্ষমতা সরকার তাঁকে দিয়েছে এটা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। এতটাই সচেতন যে ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য সরকার যেসব নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান বেঁধে দিয়েছে সেগুলোর কথা তিনি সুবিধামতো ভুলে যান। আপনি তাঁর কাছে এসেছেন খুবই বিপদে পড়ে সম্পূর্ণ আইনানুগ সিদ্ধান্ত লাভের আশায় অথচ আপনার প্রতি তিনি কৃপাদৃষ্টি দিয়ে দেখছেন, আর মনে মনে ভাবছেন আপনাকে কতটুকু ‘ছুলানো’ যায়। এই নাটকের শেষ দৃশ্যে আপনার সঙ্গে তিনি রফা করবেন ঠিকই; কিন্তু তার আগে আপনার দেহ থেকে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হবে।
৩.
উপসংহারে প্রদায়ক বা প্রদানকারী মহোদয়দের উদ্দেশে সবিনয়ে শুধু একটি কথা বলতে চাই। একদিন—এবং সেই দিনটি খুব যে একটা দূরে তা কিন্তু নয়, আপনাদেরও ওই উল্টো দিকের চেয়ারটাতে হয়তো বসতে হতে পারে। তখন আপনি নখদন্তহীন (অনেক সময় শব্দার্থে) একজন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, যাকে দেখে লোকে হয়তো সালাম দেয় কিন্তু মনে মনে বলে, ‘ব্যাটা, কী জ্বালানটাই না জ্বালাইছস যখন চাকরিতে আছিলি। এখন রাখ তোরে একবার পাইয়া লই।’ তখন আপনি কখনো যাবেন অফিসে পেনশনের খোঁজে, কখনো রাজউকে বাড়ির প্ল্যান পাস করাতে, কখনো বিদ্যুৎ, কখনো পানি, কখনো অন্য কিছুর জন্য খালি ছোটাছুটি করবেন। আর বসবেন কোথায়? না, টেবিলের উল্টো পাশে। কথাটা মনে থাকে যেন। আর স্মরণ করিয়ে দিই সেই প্রাচীন প্রবচনটি : ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে/একদিন তোরও আছে শেষে।
লেখক : মোফাজ্জল করিম, সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com