অনলাইন ডেস্ক:
৬ মার্চ, ১৯৭১। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও প্রশাসনের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ যে আলগা হয়ে গেছে তা এ দিনে এসে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খান, যাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান, তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছান ৫ মার্চ। ৬ মার্চ তাঁর শপথ গ্রহণ করার কথা। কিন্তু গণ-আন্দোলনের তীব্রতা ও আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন লক্ষ করে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিক টিক্কা খানকে গভর্নর পদে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান।
সারা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে সভা-সমাবেশ-মিছিলে। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তাঁরই নির্দেশে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে এর আগে বেতন দেওয়া হয়নি সেসব অফিস বেতন দেওয়ার জন্য খোলা থাকে।
এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আন্দোলনের জোয়ারে শামিল হতে সকাল ১১টার দিকে মিছিল করে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি বেরিয়ে আসে। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে সাতজন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।
বিকেলে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতারে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের একগুঁয়েমির জন্য প্রস্তাবিত ৩ মার্চের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। ১০ মার্চ ঢাকায় গোলটেবিল সম্মেলন আয়োজন করে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বর করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তিনি পুনরায় ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি আরো বলেন, যাই ঘটুক না কেন, যদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি, তদ্দিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব।’
বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে প্রেসিডেন্টের ভাষণ শোনেন। তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা তথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক ও ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে বাসায় জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার রক্ত এখনো শুকায়নি। শহীদের পবিত্র রক্ত পদদলিত করে ১০ মার্চ প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না।’
ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাঁর দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবনের নম্বরে টেলিফোন করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে যেভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে তা তদন্তের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের দাবি জানান। চরম কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার জন্য ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ জানান।
লাহোরে মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারা দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে। জনসভায় ভাষণের খসড়া তৈরি ও সম্ভাব্য কর্মসূচি নিয়ে বঙ্গবন্ধু দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন।
ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতারা এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সকল বেতারকেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান।