অনলাইন ডেস্কঃ
জামায়াতকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্তের প্রায় কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত আটকে গেল বিএনপি। এতে হোঁচট খেয়েছেন দলটির বেশির ভাগ নেতা। কয়েক মাস ধরে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাঁরা জামায়াতকে ত্যাগ করার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। এরপর তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মতামত দিলেই জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবারের বৈঠকে ফখরুলের এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ‘অন্যান্য আলোচ্যসূচি’ থাকার কারণে মহাসচিবের পক্ষে সেই বক্তব্য আর দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানা যায়।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ নেতা জামায়াতকে ত্যাগ করার প্রশ্নে জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আপাতত ইস্যুটি ঝুলে গেল!
গত বুধবার এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জরুরি কিছু আলোচ্যসূচি থাকায় আমার বক্তৃতা করা হয়নি। সময় হলে যথাসময়ে অবশ্যই বক্তৃতা করব।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির স্থায়ী কমিটির আরেকজন নেতার মতামত হলো, ‘আসলে মহাসচিবের বক্তৃতার অর্থ দলেরই বক্তব্য বা অবস্থান। ফলে অন্যদের মতো এত তাড়াতাড়ি জামায়াত বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে তাঁর পক্ষে উপসংহারে যাওয়া সম্ভব নয়।’ এই নেতা জানান, জামায়াত সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে অবশ্যই তিনি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন।
তবে ফখরুলের বক্তৃতা এবং জামায়াত প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় দলের মধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে শীর্ষ নেতৃত্বের ‘নতুন কৌশল’ বলে মনে করছেন। আবার কারো মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারতের প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের সঙ্গে ওই ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে বিএনপির এমন অংশটি জামায়াত প্রশ্নে দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছে বলে মনে করা হয়। অপর অংশটি ভারতবিরোধী না হলেও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলার পক্ষপাতী।
বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রণয়নে দলটির স্থায়ী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠক শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারি থেকে। অন্য সব নেতার পর সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিএনপির রাজনীতিকে আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করেন। তিনি ‘প্লুরালিজম’ বা বহুত্ববাদের কথা বলেন। তবে কী কী কারণে জামায়াতে ইসলামীকে ত্যাগ করা উচিত সে বিষয়ে তিনি সেদিন প্রায় আধাঘণ্টাসহ মোট দুই ঘণ্টা বক্তব্য দেন বলে জানা যায়। এর পরের শনিবার ২৫ আগস্ট আগের বৈঠকের মুলতবি বক্তৃতা শেষ করতে খসরুর আরো ১৫ মিনিট লাগে। ওই দিন নানা আলোচ্যসূচি এবং প্রস্তুতি না থাকার কারণে ফখরুল বক্তব্য দেননি বলে জানা যায়। কিন্তু এরপর অনেকগুলো শনিবার নানা ধরনের আলোচ্যসূচির কারণে ফখরুলের বক্তব্য দেওয়া হয়নি। ফলে বেশ কিছুদিন ইস্যুটি চাপা পড়ে যায়।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকের বিষয়ে বাইরে কথা বলা সমীচীন নয়।’
তবে গত ২৯ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর কথার সূত্র ধরে জামায়াত ইস্যুটি নতুন করে আলোচনায় গতি পায়। দলের কর্মকৌশল নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে, যেটি শুরু করা দরকার বলে টুকু ওই দিন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কথা তোলেন। এরপর বৈঠকের সভাপতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিদ্ধান্ত জানান, পরবর্তী বৈঠকে (৫ সেপ্টেম্বর) মহাসচিব বক্তব্য দেবেন। এতে দলের মধ্যে ধারণা তৈরি হয় যে ফখরুলের বক্তৃতায় জামায়াত ইস্যুটি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কারণ ফখরুল নিজেও জামায়াত ইস্যুটি নিষ্পত্তি করার পক্ষপাতী বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে জানা যায়।
এদিকে বিএনপির ভেতরকার ওই মতামতের কথা জেনে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের মাধ্যমে জামায়াতের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়া হলে খালেদা তা নাকচ করে দেন বলে জানা যায়। এ কারণেও দলে বদ্ধমূল ধারণা হয় যে জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে না রাখা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই জামায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে অবশ্যই আলাপ-আলোচনা হবে। ওই ইস্যু (জামায়াত) শেষ হবে না, এটি বলা যায় না।’
স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে সবাই বলছেন এ কথা ঠিক; কিন্তু ওদের ছাড়ার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৬ সদস্যের মধ্যে একমাত্র জমির উদ্দিন সরকার জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনিও বলেছেন, দলের সবাই যে সিদ্ধান্ত নেবেন সে ব্যাপারে তিনি একমত। এর বাইরে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক থাকার কারণে কিছুটা কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন নজরুল ইসলাম খান। তবে দলের অন্য নেতাদের জোরালো অবস্থানের কারণে তিনিও দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত বলে ঘরোয়া আলোচনায় অন্য নেতাদের জানিয়েছেন।