অনলাইন ডেস্ক:
দৃঢ় মনোবল নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন অকুতোভয় বীর। শত্রুর আঘাতে হারিয়েছেন এক হাত ও এক পা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে এক পায়ে ভর করে এগিয়ে যেতে থাকেন শত্রুর দিকে। দৃঢ় মনোবলে রাইফেল উঁচিয়ে লড়ে যান শত্রুর বিপক্ষে। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা যাঁদের স্বপ্ন, শত্রুর বুলেটের সামনেও জীবন তাঁদের কাছে তুচ্ছ। মৃত্যু কিংবা পরাজয়; কোনো কিছুতেই দমে না গিয়ে লড়ে যান যে অকুতোভয় বীর, তিনিই তো ‘সংশপ্তক’।
দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য নিশ্চিত মৃত্যুকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রশিক্ষণ বা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে যা আছে তা নিয়েই মোকাবেলা করে গেছেন সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীকে। দেশের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া এই অকুতোভয় বীরও একেকজন সংশপ্তক।
‘সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপণ যুদ্ধে অপরাজিত রণরাজ। ‘সংশপ্তক’ মানে এমন সৈন্য, যাঁরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান। ‘জয়লাভ অথবা মৃত্যু’ এই তাঁদের ব্রত। মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরদের স্মরণে ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনাকে দৃশ্যমান করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের ২৬শে মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হয় এই ভাস্কর্যটি। উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের উপাচার্য কাজী সালেহ আহম্মেদ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটির শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ফর্ম, বিষয়ভিত্তিক ও নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্যের জন্য তিনি সুপরিচিত। শিল্পী ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে। মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির উচ্চতা ২৮ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এ ছাড়া এটি নির্মাণে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাংলার আপামর জনতার স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় মানসিকতার সাহসী প্রতিবিম্ব এ ভাস্কর্য।
যোগাযোগ করা হলে সংশপ্তক ভাস্কর্যটির পেছনের গল্প বলেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালে সংশপ্তক নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। পরের বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতিসহ কয়েকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁরা একটি ভাস্কর্য করার কথা জানান। লে-আউট জমা দেওয়ার পর বিস্তারিত জানতে সেখানে আমাকে ডাকা হয়। সিন্ডিকেটসভায় আলোচনা শেষে আমি কাজ শুরু করি।’ তিনি বলেন, সংশপ্তক ভাস্কর্যে আমি কোনো ব্যক্তির মুখের অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করিনি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য অনেক বড় একটি ঘটনা। দেশকে মুক্ত করার এক দৃপ্ত প্রেরণা ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। যার যা কিছু ছিল তা নিয়েই সবাই যুদ্ধ করেছেন। জীবন উৎসর্গ করতেও কেউ পিছপা হননি। আমি তাঁদের সেই দৃপ্ত মনোবল তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘ভাস্কর্য শুধু আমাদের ইতিহাসের কথাই বলে না, বরং আমাদের আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সংশপ্তক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ত্যাগ সম্পর্কে বিশেষ বার্তা বহন করে।’