অনলাইন ডেস্ক:
পৃথিবীতে নানা পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষও বদলাচ্ছে। এই পরিবর্তনে একটা মুখোশ-মানুষের জন্ম হয়। মানুষের চেয়ে মুখোশ বড় হয়, ভালো মানুষের অভাবটাও স্পষ্ট হয়। একটা মুখ খুব বেশি করে আজ মনে পড়ছে—যে মুখটা খুব চেনা চেনা, যে মুখটা মানুষের মুখ ছিল, যে মুখটা ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।
ভালোবাসার মুখটা মানুষের জন্য তিল তিল করে ত্যাগের শক্তিতে পূর্ণতা পেয়েছিল।
মানুষের ভালোবাসার শক্তিতে আলোকিত হয়ে উঠেছিলেন জনমানুষের নেতা শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার। বহুমাত্রিক প্রতিভা তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারাকে বিকশিত করেছিল। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো মানুষ ছিলেন বলেই তাঁর একটা ভালো মন ছিল।
ভালো মন থেকে ভালো চিন্তা উৎসারিত হয়, যা মানুষকে বহুমাত্রিক করে তোলে। মানুষ হয়তো সেটা নিজেও বুঝতে পারে না। অথচ কর্ম ও অবদান ইতিহাসে তাঁকে মহানায়কে পরিণত করে। তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নিজের জীবনের কথা কখনো ভাবেননি, বরং ভেবেছেন নিজের জীবন উৎসর্গ করে কিভাবে দেশকে স্বাধীন করবেন। লড়েছেন বীরের মতো। দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যেমন যুদ্ধে নেমেছিলেন। দেশে গণতন্ত্র যখন বিপন্ন হয়েছে, তখন আবার গণতন্ত্র রক্ষায় নিজেকে নিবেদিত করেছেন। দেশের মানুষের এই বিপদের দিনে মানুষের সঙ্গে থেকেছেন। রাজপথে নেমেছেন, গণতন্ত্রের খলনায়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। জেল-জুলুম, মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; কিন্তু কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে নেমেছিলেন, গণতন্ত্রের আন্দোলনেও জীবন বাজি রেখেছেন। ঘাতকদের বুলেটে ঝাঁজরা হয়েছে শরীর। রক্ত গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। মানুষ কেঁদেছে, মাটি কেঁদেছে, দেশ কেঁদেছে। গণতন্ত্রের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে সেদিন সারা দেশের মানুষ যেভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল, তেমনটা আর বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। মৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সে দিনটি ছিল ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট। শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার নিজের প্রাণ দিয়ে গণতন্ত্রের যে উত্থান ঘটিয়ে গেছেন সেটিকে জাতীয় জনজাগরণ দিবস ঘোষণা করা হোক।
মহান স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনে তাঁর ত্যাগের দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে; যেখানে উদারতা ও চিন্তাশীলতা মূলশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্বাস একটি দর্শন, যা থেকে জীবনবোধের জন্ম হয়। সে বিশ্বাসের দর্শন দ্বারা নিজে প্রভাবিত ছিলেন শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার। কেবল নিজের মধ্যে সে বিশ্বাসের দর্শনকে ধারণ করেননি, বরং বিশ্বাসের পরীক্ষায় প্রতিনিয়ত জিতেছেন। নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, বিশ্বাসের মতো অনুভূতিশীল চেতনার চেয়ে আর অন্য কিছু বড় হতে পারে না। কিন্তু আজ বিশ্বাসের সেই জায়গাগুলোতে আগাছা-পরগাছা, পরজীবীর জন্ম হয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মতো বিরূপ ধারণার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সত্য হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যা হচ্ছে সত্য।
শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার নিজে শিক্ষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষার দর্শন মানবিক চিন্তার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাঁর হাতের জাদুকরী শক্তি কাদামাটির মতো যত্ন করে তৈরি করেছে প্রতিভাধর শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের উদার চিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধের দর্শনে নিয়ে নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি ছাত্ররাজনীতিকে সব ধরনের অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর পথ দেখিয়েছেন।
তিনি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছেন। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁর সামগ্রিক দর্শন রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি শ্রমিকদের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও আদর্শকে সব সময় অনুসরণ করে গেছেন। অথচ শ্রমিকরা এখন নানা দুষ্টচক্রের অদৃশ্য সুতায় আটকা পড়েছে। অদ্ভুত এক আঁধার গ্রাস করেছে জীবনবোধকে।
তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো পারিবারিক বন্ধনের দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন ছিল তাঁর রাজনীতির মূলশক্তি। তিনি মাটির মানুষ। মাটির মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে নিজের সব কিছু ত্যাগ করে রাজনীতি করে গেছেন। সুখে-দুঃখে মানুষের সঙ্গে মিশে তিনি জনমানুষের নেতা হয়েছেন। সেই রাজনীতিতে কোনো শঠতা ছিল না। বরং সেখানে ছিল মানুষের জীবনের জয়গান, কল্যাণ আর সম্ভাবনা।
শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার—এমন মানুষ আর দেখছি না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য এমন মানুষ আজ খুব দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর