অনলাইন ডেস্ক:
কলকারখানা খোলা রেখেই আগামী বুধবার থেকে এক সপ্তাহের ‘লকডাউনের’ সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে পরে আবার মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিলে আজ সোমবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
‘লকডাউনে’ জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস ও গণপরিবহন বন্ধ রাখার বিষয়টি আগে থেকেই বলা হচ্ছে।
গতকাল রবিবার মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে কলকারখানা খোলা রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা কলকারখানা খুলে রেখে ‘লকডাউনে’ যাওয়ার পক্ষে পরামর্শ দেন। সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তারা সে বিষয়টি আমলে নিয়ে ‘লকডাউনের’ সুপারিশ চূড়ান্ত করে সেটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন। রাত ৮টায় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আসেনি।
উল্লেখ্য, সরকার গঠিত কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দুই সপ্তাহের পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছে। গত শুক্রবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সারা দেশে উদ্বেগজনকভাবে কভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধি-নিষেধ সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। বিধি-নিষেধ আরো শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার। অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণ লকডাউন ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
করোনা মোকাবেলায় ১৮ দফা নির্দেশনা জারির পরও পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় কয়েক দিন আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আগামী বুধবার, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ কথা বলেন। এই ‘লকডাউনে’ কী ধরনের বিধি-নিষেধে থাকবে দেশ, এ নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। গত বছরের মতো সাধারণ ছুটি হবে, নাকি কিছু বিষয়ে ছাড় থাকবে। ছাড় থাকলে কী কী বিষয়ে ছাড় থাকবে? ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ যদি না হয় তাহলে সংক্রমণ রোধ করা আসলে সম্ভব হবে কি না—এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
গতকাল সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুই সপ্তাহ লকডাউনের বিষয়ে আলোচনা হয়। লকডাউনের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। তবে প্রথমে এর সময় এক সপ্তাহ এবং পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়ানোর কথা বলা হয়।
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন যুক্তি তুলে বলেছেন, কলকারখানা বন্ধ করলে ‘লকডাউনের’ উদ্দেশ্য বিফল হবে। ব্যবসায়ীদের যুক্তিকে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এরই মধ্যে আজ সোমবার ও আগামীকাল মঙ্গলবার গত কয়েক দিনের মতো দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখে যেভাবে চলেছে সেভাবেই চলবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
বুধবার থেকে কার্যকর হতে যাওয়া লকডাউনের বিষয়ে গতকাল উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, গতবারও সাধারণ ছুটি দেওয়ার কিছুদিন পর কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এবার গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ক্রয়াদেশগুলো যে পর্যায়ে আছে, সে অবস্থায় কারখানা বন্ধ করে দিলে দেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেন, তাই চূড়ান্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে কলকারখানা খোলা রাখার যুক্তি তুলে ধরেন অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেন, গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের বয়স ১৮-৩০ বছর। এই খাতে কাজ করা শ্রমিকদের গড় বয়স ২৪ বছর। এই বয়সের শ্রমজীবী মানুষেরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন না বলেই চলে। বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের হার মাত্র ০.৩ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, যতই গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখুক সরকার, কলকারখানা বন্ধ করলে শ্রমিকরা কোনো না কোনো উপায়ে গ্রামের বাড়িতে যাবেই। গতবার সাধারণ ছুটির সময় মাছের ড্রাম, অ্যাম্বুল্যান্সসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার উদাহরণ তুলে ধরেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, যাঁরা গার্মেন্টে কাজ করেন তাঁদের যাতায়াত খরচ ও সময় বাঁচাতে ৯০ শতাংশ শ্রমিকই কারখানার আশপাশে বাস করেন। বেশির ভাগ শ্রমিক হেঁটে ও বাইসাইকেলে করে কর্মস্থলে আসেন। বাকি ১০ শতাংশের জন্য কোনো সমস্যা হবে না। তাই কলকারখানা সাধারণ ছুটির বাইরে থাকলে লকডাউনের উদ্দেশ্য পূরণে বাধা না হয়ে বরং ইতিবাচক হবে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সাধারণ ছুটিতে কলকারখানা বন্ধ থাকলে মানুষ গ্রামের বাড়ি গিয়ে সংক্রমণের হার বাড়াবে। দেশে বর্তমানে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।
বৈঠক অংশ নেওয়া দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘বৈঠকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের কারখানা খোলা রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে সরকার।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা আমাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছি। মন্ত্রিপরিষদসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এসব যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানার চেষ্টা করলেও মন্ত্রিপরিষদসচিব টেলিফোন ধরেননি। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন সচিব জানান, ব্যবসায়ীরা তাঁদের ক্রেতাদের বিভিন্ন শর্তের কারণে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনেই কারখানা চালান বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তাঁদের যুক্তি শুনে মন্ত্রিপরিষদসচিব এসব নিয়ম-কানুন আরো কঠোরভাবে মেনে চলার তাগিদ দেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকের আগেই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক কলকারখানা যেন খোলা রাখা হয়, সেই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে করা সংবাদ সম্মেলন করে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ইএবিসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ দাবি জানায়।