অনলাইন ডেস্ক:
‘গোল্ডেন মনিরের’ প্রধান সহযোগী তিনি। তাই তাঁর নামের সঙ্গেও তকমা হিসেবে যুক্ত হয়েছে সোনা শব্দটি। সোনা শফি। একসময় ছিলেন লাগেজ পার্টির সদস্য। বিমানবন্দর এলাকায় একটি হত্যা মামলায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষের সাক্ষী হয়ে বিশেষ মওকা পেয়ে যান তিনি। গড়ে তোলেন সোনা চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে হয়ে যান কোটিপতি ব্যবসায়ী। শুরু করেন মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার।
এ রকম লোকরা যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন ভিড়ে যান সে দলে। একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ‘সোনা শফি’ ভোল পাল্টে হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। নির্বিঘ্নে টাকা পাচার করতে ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে সিভিল এভিয়েশনে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। টানা তিন বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলে ইজারাদার ছিল এই প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন জমজম টাওয়ারের অন্যতম মালিক তিনি। নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক এই ব্যক্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর।
মো. শফিকুল ওরফে শফিক নামের এই জনপ্রতিনিধিকে রাজধানীর উত্তরা ও উত্তরখান এলাকার অনেকেই ‘সোনা শফি’ নামেই চেনে। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার চোরাকারবারি ও ভূমিদস্যু মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের প্রধান সহযোগী এই ‘সোনা শফি’। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এলাকায় ব্যাপক দাপট দেখিয়ে বেড়ানো এই জনপ্রতিনিধি স্থানীয় এক কলেজের অধ্যক্ষকেও লাঞ্ছিত করেন। মনিরের গ্রেপ্তারের পর নাম আলোচনায় আসতেই গাঢাকা দিয়েছেন তিনি। তাঁর ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে র্যাবসহ সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সোমবার অনেকবার শফিকুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাইরে অপরাধ কর্মকাণ্ডে গোল্ডেন মনিরের সহযোগীদের মধ্যে সোনা শফি ছাড়াও চার চোরাকারবারির তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গেও সখ্য ছিল মনিরের। মনির-শফির সোনা চোরাচালান দলের অন্যতম হোতা রিয়াজ উদ্দিন আগে একবার গ্রেপ্তার হলেও ধামাচাপা দিয়েছেন অপকর্ম। এখন তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য গুলশান ১ নম্বরের ডিসিসি মার্কেটে প্রসাধনীর লাগেজ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। নামে-বেনামে শতকোটির টাকার মালিক এই সালেহ আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই। তবে এই সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য মোহাম্মদ আলী সোনা, বিদেশি মুদ্রাসহ গ্রেপ্তারের পর এখন জেলহাজতে আছেন। আরেক হোতা ঢাকার বাড্ডা এলাকার সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম কয়েক বছর ধরেই বিদেশে পালিয়ে আছেন। মনির গ্রেপ্তারের পর তাঁদের সবার ব্যাপারে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তিন চোরাকারবারির সঙ্গে মিলে উত্তরার জমজম টাওয়ারের মালিক হওয়া মনির তাঁর অংশ সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে দাবি করছেন অন্যরা। শফিও কয়েক মাস আগে বিমানবন্দরের ঠিকাদারি ব্যবসা বন্ধ করেছেন। শফির নিয়ন্ত্রণে থাকা জমজম টাওয়ারে তাঁদের অফিস আছে। সেখানে তিন দিন ধরে তালা ঝুলছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মনির গ্রেপ্তারের পর রবিবার থেকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না কাউন্সিলর শফিকে। রবিবার র্যাব জমজম টাওয়ারে তল্লাশি চালানোয় অন্য মালিকরাও গাঢাকা দিয়েছেন। সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান করোনা পজিটিভ হওয়ার পর গত দেড় মাস রাজধানীতে চিকিৎসাধীন আছেন। গতকাল তাঁর মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
মনিরের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় দায়ের করা তিনটি ফৌজদারি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে ১৮ দিনের রিমান্ডে আছেন তিনি। গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘মনিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে এবং এর পেছনে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে র্যাব অনুসন্ধান চালাবে।’
একাধিক সূত্র জানায়, উত্তরখানের কাচকুড়া এলাকার শফি নব্বইয়ের দশকে ছিলেন বিমানবন্দর এলাকার হকার। পরে চোরাকারবারির লাগেজ পার্টির সদস্য হন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক হয়।
১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সুরত মিয়া ওরফে এস মিয়া নামে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এক বাংলাদেশি মদ্যপ অবস্থায় অসংলগ্ন আচরণ করেন। একপর্যায়ে তাঁর পেটে কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এস মিয়ার স্ত্রী সৈয়দা শামসিয়া বেগম ক্যান্টনমেন্ট থানায় তিন কাস্টমস কর্মকর্তাকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় কাস্টমসের পক্ষে আদালতে সাক্ষী হন শফি। জনশ্রুতি আছে, ওই সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে সোনা চোরাচালানে সহায়তা দেন কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা। এতে শফি-মনির সিন্ডিকেটের কারবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাঁদের সঙ্গে সালেহ, রিয়াজ, আলীও ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যান। অবৈধ টাকায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজউক ও গণপূর্তের জমি নিজেদের দখলে নেওয়ার মিশনে নামেন। উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ২০ কাঠা জমির ওপর জমজম টাওয়ার ছাড়াও ১১ নম্বর সেকশনে সাফা টাওয়ারের অংশীদার শফি। এ ছাড়া উত্তরখানসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তাঁর বহুতল ভবন আছে। দেশে-বিদেশে রয়েছে অঢেল সম্পদ। ২০০৭ সালে সোনা চোরাচালানে মামলা হওয়া এবং ২০০৮ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ভোল পাল্টান শফি। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একপর্যায়ে বৃহত্তর উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক হন। বর্তমানে তিনি উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁর ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলের ইজারায় ছিল গত তিন বছর। এই সুযোগে সংরক্ষিত এলাকায় অবাধ যাতায়াতের নিরাপত্তা পাস কাজে লাগিয়ে সোনা ও মুদ্রা পাচার করেছেন নির্বিঘ্নে। চলতি বছরের জুন মাস থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠান সেখানে দায়িত্বে নেই।
সূত্র জানায়, শফিক ওরফে শফি উত্তরখানের কাচকুড়া বেতগী গ্রামের মৃত হাজী ফজন উদ্দিনের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে উত্তরার দুই থানায় কয়েকটি মামলা আছে। স্থানীয় কাচকুড়া কলেজের এক শিক্ষিকাকে হয়রানি করেন শফিকের ফুফাতো ভাই শ্যামল মিয়া। এ ঘটনায় মামলা হলে কলেজের অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন মিঞাকে লাঞ্ছিত করেন শফিক। ২০১৬ সালের এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন মিয়া। ওই ঘটনায় মামলাও হয়। তবে প্রভাবশালী শফিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হওয়ার পরে এলাকায় আরো আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি।
এদিকে গুলশান-১-এর ডিসিসি মার্কেটের প্রথম তলায় ‘আশিয়া এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রসাধনীর দোকান রয়েছে মনির সিন্ডিকেটের সদস্য সালেহ আহমেদের। লাগেজের প্রসাধনীর এই কারবারির কোটি টাকা মূল্যের প্রাডো গাড়িসহ একাধিক গাড়ি রয়েছে। গুলশান ১ নম্বর সেকশনে ২৩/বি নম্বর সড়কে আছে বিলাসবহুল বাড়ি। সালেহের একাধিক বাড়ি আছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেড় মণের বেশি সোনা ও তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যের সৌদি রিয়ালসহ সোনা চোরাকারবারি মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রিয়াজ ও সালেহর নাম উঠে আসে। সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিনকে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর জামিনে ছাড়া পেয়ে আছেন বহাল তবিয়তে।
মনিরের অনেক সম্পদই চার চোরাকারবারির সঙ্গে যৌথভাবে করা। এক মাস ধরে মনিরের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি টের পেয়ে যায় চোরাকারবারিচক্রটি। তখনই কৌশলে উত্তরার জমজম টাওয়ারের মালিকানা ছেড়ে কৌশল পাল্টান গোল্ডেন মনির। এসব কাজে তাঁকে সহায়তা করেন শফি। সূত্র জানায়, জমজম টাওয়ারে হায়দার নামে সিরাজগঞ্জের আরেকজন মালিক আছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজের ঘনিষ্ঠ হয়ে হায়দারও চোরকারবারি সিন্ডিকেটে যোগ দেন।