অনলাইন ডেস্ক:
জুলাই ২০০৭, কৃষ্ণ ১৬ই জুলাই। তখনো ফোটেনি আলো পুবের আকাশে। শ্রাবণ মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরছিল ফোঁটায় ফোঁটায়। রাত ভোর হয় হয় এমন সময়, ধানমণ্ডির রাস্তায় যৌথ বাহিনী। ঘিরে ফেলল সুধা সদন। ধীরে ধীরে আশপাশের বাড়িগুলোর আলো জ্বলে উঠল। জানালাগুলো খুলে গেল। খবর চলে গেল গণমাধ্যমেও। সাজানো নাটকের মঞ্চে রচিত হলো এক কালো অধ্যায়। দিনের আলো ফুটে উঠল, নাকি কালোয় ঢেকে গেল সকালের পবিত্র নরম আলো!
টেলিভিশনের পর্দায় চোখ দেশের মানুষের। ভক্তরা সারিবদ্ধ পথের দুই ধারে। প্রিয় নেত্রীকে বন্দি করা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে সাজানো আদালতে। নাটকের দৃশ্যপট যেমন বদলায়, ঠিক সে রকম আদালত থেকে সোজা সাবজেলে যাওয়া। গুছিয়ে চিত্রনাট্য আগেই লেখা ছিল। তৈরি ছিল অনুগত কুশীলবরাও। লেখা সংলাপের বাইরে যাওয়ার সুযোগও ছিল না কারো। অসহায় দৃষ্টিতে দেশের মানুষ দেখে, গণতন্ত্র কারারুদ্ধ হয়। হ্যাঁ, গণতন্ত্রই তো কারারুদ্ধ হয়েছিল সেদিন। গণতন্ত্রের মানসকন্যা তিনি। তাঁর কারাবাস তো গণতন্ত্রেরই কারাবাস।
গ্রেপ্তারের আগে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়। ওই সব মামলায় তাঁকে দীর্ঘ ১১ মাস আটক রাখা হয়। কারাগারের পাশেই সংসদ ভবন চত্বরে তাঁর বিচারের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল বিশেষ আদালত। শুরু হয়েছিল বিচারপ্রক্রিয়াও।
২০০৭ থেকে ২০০৮, তত্ত্বাবধায়ক নাম নিয়ে চেপে বসা সরকারের উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা তো পরিষ্কার সবার কাছেই। অতীতে এ ধরনের লেবাসধারীরা যেসব কথা বলে চেয়ারে চেপে বসে, তারাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কত যে মধুর কথা শুনিয়েছিল সেই ‘চেপে বসা’ সরকার! কী করবে তারা? রাজনীতির ক্ষেত্রে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছিল মানুষের মনে, তা কী করে হয়? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি কী করে এক লেভেলে থাকে? প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বিছায় চক্রান্তের জাল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় সংকীর্ণ হীনম্মন্যতায়। একের পর এক জারি হয় ফরমান। তখন অবস্থা ছিল এমন যেন রাজনীতি করার মতো গর্হিত কাজ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। বাংলাদেশের যত রাজনীতিবিদ, কারো কোনো নীতি নেই—এটা প্রমাণের কী যে চেষ্টা তাদের।
‘চেপে বসা’ ওয়ান-ইলেভেনের শাসককুল যেন নতুন করে ফিরিয়ে আনে এবডো ও পোডো। আইয়ুবি শাসন যেন ফের ফিরে আসে স্বাধীন বাংলায়। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই রাজনীতিবিদদের নানা সংকটে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। গণতন্ত্র ‘মৌলিক’ করতে গিয়ে ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর একটি হলো পোডো-PODO|। অন্যটি এবডো-EBDO। পোডো মানে হলো পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার। আর এবডো মানে হলো ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার। পোডো আইন প্রয়োগ করে অনেক রাজনীতিবিদকে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিগত আমলে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয় আগে ক্ষমতায় থাকা অনেক রাজনীতিবিদকে। সামরিক আদালতের একতরফা বিচারে অনেকেই হেনস্তা হন। আইন করা হলো, যাঁরা পোডো আইনে অভিযুক্ত হবেন, তাঁরা এবডো আইনে ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ওই আইনে ৪২ জন বাঙালি নেতা রাজনীতিতে অযোগ্য হয়ে পড়েন। অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে অবসরে চলে যান।
সেই সময়টা যেন ফিরে আসে ফের ২০০৭ সালে। তখন সমালোচনা করা নিষেধ। রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রায়। তখন চলতে হতো নিয়ম-রীতি মেনে। নিয়ম মেনে বলতে হতো মনের কথাও। তখন হাস্যরস নিন্দনীয় ছিল, প্রশ্ন করা তো ছিল ঘোর অপরাধ। সেই সময়ে গ্রেপ্তার করা হলো তাঁকে, ১৯৮১ থেকে যিনি রাজপথে সোচ্চার। জনতার দাবি আদায়ের মিছিলে যিনি সবার সামনে, তাঁকে নেওয়া হলো নির্জন কারাগারে। কী অপরাধ তাঁর?সীমাহীন মহামানবের দায় কাঁধে নিয়ে দেশসাধনার অন্তহীন ক্ষেত্রে বাস করতে চেয়েছেন তিনি, এই কি ছিল তাঁর অপরাধ? তিনি জ্ঞানে ও কর্মে মানুষে মানুষে মিলিয়ে একটি দেশ নির্মাণ করতে চেয়েছেন, এই কি ছিল তাঁর অপরাধ?দেশের ভবিষ্যতের জন্য উৎসর্গীকৃত তাঁর বর্তমান। ব্যক্তিগতরূপে ভোগ না করে তিনি এমন এক ভবিষ্যৎ রচনা করতে চেয়েছেন, যেখানে দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে গর্ব করা যাবে। এটাও কি অপরাধ ছিল তাঁর?
তবে তিনি তো এক ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা। কারাগারের নির্জনতাকে তিনি আশীর্বাদ হিসেবেই নিয়েছিলেন। লিখেছেন কারাবাসের স্মৃতি। যদি নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জিতে যায় তাহলে তিনি কী করবেন, তার বছরওয়ারি পরিকল্পনা করেছেন কারাজীবনে।
যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হচ্ছে তাঁর কন্যা বাংলাদেশের চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। তিনি আজ বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখান। বাংলাদেশও স্বপ্ন দেখে তাঁকে নিয়ে। জনকল্যাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে যাঁর দীক্ষা, তাঁর স্বপ্ন তো দেশকে ঘিরেই বিস্তৃত হবে। তাঁর হাত দিয়েই রচিত হবে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার নতুন এক ইতিহাস।
লেখক : আলী হাবিব, সাংবাদিক, ছড়াকার
habib.alihabib@gmail.com