মদিনা মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ নগরী। মক্কা নগরীর পরই তার মর্যাদা। এই নগরীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহানবী (সা.)-এর সুদীর্ঘ স্মৃতি। আর এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদিনা নগরী ও তার অধিবাসীদের কথা এসেছে। যার কয়েকটি হলো :
১. বরকতের সঙ্গে প্রবেশ : রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন আল্লাহ তাকে নিম্নোক্ত দোয়া শিক্ষা দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বোলো, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে নিষ্ক্রান্ত করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং তোমার কাছ থেকে আমাকে দান করো সাহায্যকারী শক্তি।
২. মদিনা নগরীর শপথ : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মদিনা নগরীর শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি শপথ করছি, এই নগরের। আর তুমি এই নগরের অধিবাসী।
৩. দ্বিনের প্রশস্ত ভূমি : আল্লাহ মদিনাকে দ্বিনের জন্য উন্মুক্ত ও প্রশস্ত ভূমি বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ওপর অবিচার করে তাদের প্রাণ গ্রহণের সময় ফেরেশতারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম। তারা বলে, আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরত করতে? তাদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এই আয়াত মক্কার সেসব মুসলমানের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পরও সেখানে থেকে গিয়েছিল। বদর যুদ্ধের সময় তাদের মুসলমানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সুতরাং আয়াতে প্রশস্ত ভূমি দ্বারা মদিনাকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা তখন মুসলমানদের মদিনাতেই হিজরতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
৪. আল্লাহর ভূমি : উল্লিখিত আয়াতে মদিনা নগরীকে ‘আল্লাহর ভূমি’ বলা হয়েছে। যা মদিনা নগরীর বিশেষ মর্যাদা প্রমাণ করে।
৫. রাসুলের আবাস : কোরআনে আল্লাহ মদিনাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আবাসস্থল বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা এমনই, যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে ন্যায়সংগতভাবে তোমার ঘর থেকে বের করেছিলেন। অথচ মুমিনদের একদল তা পছন্দ করেনি।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৫)
উল্লিখিত আয়াতে আবু সুফিয়ানকে ধরতে মহানবী (সা.) যুদ্ধাভিযানের কথা বলা হয়েছে। আবু সুফিয়ানের কাফেলা শাম থেকে মক্কায় ফিরছিল এবং নবীজি (সা.) মদিনা থেকে তাদের ধরতে বের হন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
৬. পবিত্রতা পছন্দকারী : কোরআনে মদিনার কুবা অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রশংসা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর, তাই তোমার নামাজের জন্য অধিক যোগ্য। সেখানে এমন লোক আছে, যারা পবিত্রতা অর্জন ভালোবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৮)
তাফসিরবিদরা একমত যে আয়াতটি মসজিদে নববী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মসজিদে কুবার মুসল্লিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল।
৭. আল্লাহর ক্ষমা লাভকারী : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মদিনার অধিবাসী আনসার সাহাবিদের ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহপরায়ণ হলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি, যারা তার অনুসরণ করেছিল সংকটকালে—এমনকি যখন তাদের একদলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হয়েছিল। পরে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন; তিনি তাদের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১১৭)
৮. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভকারী : আল্লাহ মদিনার আনসার সাহাবিদের ব্যাপারে নিজের সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহাসাফল্য।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০০)
৯. অন্যকে অগ্রাধিকার দানকারী : আল্লাহ মদিনার আনসার সাহাবিদের প্রশংসা করে বলেছেন, তারা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের জন্যও, মুহাজিরদের আগমনের আগে যারা এই নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে। তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা রাখে না। তারা তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৯)
১০. ছিল মুনাফিকদের আনাগোনা : মদিনায় যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভকারী সাহাবিরা ছিলেন, তেমনি ছিল মুনাফিক ও অবিশ্বাসীদের আনাগোনা। তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করব; এরপর এই নগরীতে তোমার প্রতিবেশী হিসেবে তারা স্বল্প সময়ই থাকবে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৬০)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন