কুষ্টিয়া প্রতিনিধি :
মানুষ যখন রাতে ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে লেপ-কম্বলের তলায় নিশ্চিন্তে ঘুমায় তখন স্বপন আলী ফকির গোয়াল ঘরে শুয়ে অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটান। শুধু স্বপন আলী ফকির নন, কুষ্টিয়া পৌর এলাকার শহরতলি মিনাপাড়াসহ পাশের দুটি গ্রামের গরু ও গাভী পালনকারী কৃষকদের ভরা পৌষ মাসে এভাবেই রাত কাটছে। কারণ, গত দুই বছরে মিনাপাড়াসহ পাশের দুটি গ্রাম থেকে চুরি গেছে ৪৩টি গরু আর মহিষ। কেবল গরু-মহিষ নয়, এ সময়ে চুরি হয়েছে ২০টির বেশি সেচ পাম্প।আলোচিত মিনাপাড়া মহল্লার পাশেই রয়েছে জগতি পুলিশ ক্যাম্প।তবুও সেখানে ঘটছে একের পর এক চুরির ঘটনা। সর্বশেষ রবিবার রাতে মিনাপাড়ার কাজীরুল ইসলামের তিনটি গরু চুরি গেছে। যার দাম প্রায় ২ লাখ টাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের মহল্লার পাশ দিয়ে চলে গেছে কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক। আগে তাদের এলাকায় তেমন একটা চুরির ঘটনা না ঘটলেও সম্প্রতি এ বাইপাস সড়ক চালুর পর চুরির ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। চোরের দল গরু চুরির পর কোনো যান্ত্রিক যানে করে খুব সহজেই গরু নিয়ে পালিয়ে যেতে পারছে।তারা বলেন, গত দুই বছরে মিনাপাড়া, কাটা জুলাপাড়া মহল্লা ও ঢাকা ঝালুপাড়া থেকে ৪৩টির বেশি গরু ও মহিষ চুরি গেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় চোরদের সঙ্গে জেলার ভেড়ামারা উপজেলার কিছু গরু-মহিষ ব্যবসায়ীর যোগসাজশ রয়েছে।চোরদের কাছ থেকে চোরাই গরু-মহিষ ওই ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে চলে যায় পাশের জেলা পাবনার বিভিন্ন পশু হাটে। ঢাকা ঝালুপাড়া এলাকার কৃষক আবদুল হান্নান জানান, সম্প্রতি তার দুটি গাভী গরু চুরি হয়েছে। গাভীর দুধ বিক্রির টাকায় তার সংসারের বেশিরভাগ ব্যয় নির্বাহ হয়। এ কারণে গাভী দুটি হারিয়ে তিনি বিপাকে পড়ে যান। রাতে গাভী চুরি হওয়ার পর তিনি পরদিন সকালে জেলার একটি পশুহাটে যান, যদি চোরেরা গরু হাটে তোলে এই আশায়। সেই হাটের এক ব্যাপারী হান্নানকে জানান কুষ্টিয়া থেকে চুরি করা গরু ধরা পড়ার ভয়ে স্থানীয় হাটে তোলা হয় না। এসব গরু বিক্রি হয় পাশের পাবনা জেলার হাটে। সেই অনুযায়ী হান্নান এক দিন পর পাবনার গাভী গরু কেনাবেচার জন্য প্রসিদ্ধ আতারপাড়া পশু হাটে গিয়ে গরু নিয়ে আসার রাস্তার পাশে ওতপেতে বসে থাকেন।দুপুরের দিকে তিনি হাটে আসা একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত গরু বোঝাই ট্রাকে তার একটি গাভী দেখতে পান। পরে হান্নান বিষয়টি ওই হাটের ইজারাদারকে জানান। ইজারাদার ওই ট্রাকের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন এসব গরুর মালিক কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামের গরু ব্যবসায়ী আলাল ব্যাপারীর। এরই একপর্যায়ে গরুর ট্রাকে থাকা লোকজন সটকে পড়ে। খবর পেয়ে আবদুল হান্নানের কয়েকজন আত্মীয় হাটে চলে আসেন। সবার চাপাচাপিতে হাটের ইজারাদার হান্নানকে গাভীটি হস্তান্তর করেন। এদিকে চুরি যাওয়া অপর গাভীটি ফেরত পাওয়ার আশায় ভুক্তভোগী হান্নান আলাল ব্যাপারীর ঠিকানা জোগাড় করে তার সঙ্গে দেখা করেন। আলাল ব্যাপারী সে সময় জানান, তিনি গাভী দুটি একই উপজেলার জুনিয়াদহ গ্রামের শিশির ব্যাপারীর কাছ থেকে কিনেছিলেন। তিনি হান্নানকে আশ্বাস দেন অপর গাভীটিও ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তবে দু-এক দিন ঘুরানোর পর সেই গাভী ফেরত না দিয়ে আলাল গাভী মালিক হান্নানকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘একটা গাভী নিয়েই সন্তুষ্ট থাক, চোরদের সঙ্গে লাগতে যেও না। কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। ’ এর পর এ বিষয় নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি আবদুল হান্নান।এদিকে, মূল্যবান গরু-মহিষ রক্ষায় কৃষকরা রাতের বেলা মোটা শিকল ও তালা দিয়ে পশুগুলোকে আটকে রাখে। কিন্তু কৃষকদের কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থাই কাজে আসছে না। সংঘবদ্ধ চোরচক্র কৃষকের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে গরু-মহিষ। এ কারণে সারা বছর পরিবারের কেউ না কেউ গোয়াল ঘরে রাত কাটান। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দুই বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার গরু-মহিষ চুরি গেছে মিনাপাড়াসহ তিনটি মহল্লা থেকে। পাশাপাশি খেতের সেচ পাম্প ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাও চুরি হচ্ছে হরহামেশা। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে তিনটি গ্রাম থেকে ২০টির বেশি সেচ পাম্প চুরি হয়েছে। জানা যায়, ‘ম’ আদ্যাক্ষরের স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ভাই এই চোর সিন্ডিকেটের পালের গোদা। এ কারণে এলাকার সাধারণ মানুষ চোরদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পান। ভুক্তভোগীদের মধ্যে কয়েকজন চুরির ব্যাপারে কুষ্টিয়া সদর থানায় জিডি করলেও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গ্রাম তিনটির পাশেই জগতি পুলিশ ক্যাম্পের অবস্থান হলেও তাদের ভূমিকা রহস্যজনক।তবে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এস এম তানভির আরাফাত জানিয়েছেন, বিষয়টি তাকে মর্মাহত করেছে। ঘটনাটি জানার পর তিনি অধস্তনদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, এই চক্রের প্রত্যেককে সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে।