অনলাইন ডেস্ক:
‘যদি মন কাঁদে/তুমি চলে এসো, চলে এসো/এক বরষায়…/এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/জল ভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়…।’ প্রিয় কারো উদ্দেশে এই আহ্বান জানিয়েছিলেন নিজের লেখা গানে। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। একটি উপন্যাসের নামও রেখেছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’। গাজীপুরের নির্জন জঙ্গলে নিজের গড়া নুহাশপল্লীতে একটি সুন্দর বাংলো গড়ে সেটারও নাম দিয়েছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’। ৯ বছর আগে বৃষ্টিমুখর এক দিনেই পাড়ি জমান অনন্তলোকের উদ্দেশে। আজ আবার ফিরে এলো শ্রাবণের সেই বৃষ্টিমুখর দিন, বাংলা সাহিত্যের বিপুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় বাংলার কিংবদন্তি এই লেখকের। ওই বছরের ২৩ জুলাই তাঁর মরদেহ আনা হয় দেশে। পরদিন নুহাশপল্লীর বৃষ্টিবিলাসের পাশে সমাহিত করা হয়।
লেখালেখি আর সিনেমা-নাটক নির্মাণের মাধ্যমে সব বয়সী মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই লেখক-নির্মাতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছরের মতো এবারও আনুষ্ঠানিক তেমন কোনো আয়োজন থাকছে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দ্বিতীয়বারের মতো আনুষ্ঠানিক আয়োজন বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে এবারও পরিবারের সদস্যরা নুহাশপল্লীতে যাবে। কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। সকালে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কোরআন খতম ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে বলে নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধায়ক কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ১৯৭২ সালে প্রকাশের পরপরই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। এরপর একের পর এক উপন্যাস লিখে পেয়েছেন অতুলনীয় জনপ্রিয়তা। তাঁর একটি নতুন বই আর সেই বইয়ে একটি অটোগ্রাফের জন্য বাংলা একাডেমির বইমেলায় তরুণ-তরুণীদের দীর্ঘ লাইন বইপ্রেমীদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। এ দেশে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা এই লেখক দুই শতাধিক ফিকশন ও নন-ফিকশন বই লিখেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘দেয়াল’, ‘বাদশা নামদার’, ‘কবি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘লীলাবতী’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘নৃপতি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘নক্ষত্রের রাত’ ইত্যাদি।
হিমু, মিসির আলীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করে লাখো-কোটি পাঠক-ভক্ত তৈরি করেছেন এই কথার জাদুকর। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের সূচনা তাঁর হাত ধরেই।
হুমায়ূন আহমেদ যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। টিভি নাট্যকার হিসেবেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়। প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর লেখা নাটক যখন বিটিভিতে প্রচারিত হতো তখন রাস্তাঘাটে জনসমাগম কমে যেত। হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ ও জীবনঘনিষ্ঠ নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ এই দেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন।
পেশায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। নিজের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ প্রভৃতি। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে ছিলেন আমুদে মানুষ। নানামাত্রিক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দে মাতিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন জীবনভর। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।