সড়ক পরিবহন আইন যখন আশা আলো দেখাচ্ছে ঠিক তখন সড়কে অকাতরে ঝরছে তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। কোনোক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু রোধকরা যাচ্ছে না। অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদহীন সংযোগ এবং অসচেতনতার কারণে অকাতরে মানুষ প্রাণ দিচ্ছে। দায়িত্বে অবহেলার পরিণাম কী ভয়াবহ আর মর্মান্তিক হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জয়পুরহাটে রেলের ধাক্কায় বাসের ১২ যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনাটি। শনিবার সকালে ঘটেছে এ দুর্ঘটনা। জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস হিলি স্থলবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট অতিক্রম করার সময় গেটম্যান বার না ফেলার কারণে বাসটি রেললাইনের উপর উঠে যায়। সেসময় রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন বাসটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রেনটি রেললাইন ধরে বাসটিকে প্রায় আধা কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায়। এতে বাসে থাকা ১০ জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচজন। এছাড়াও আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত ১৬ জন। ভোর পৌনে ৩টার দিকে কসবা উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে চালকের অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। একটি প্রতিবেদন দ্বারা জানা যায় আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) নিহত আট শতাধিকলোক। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ছয় শতাধিক।
এটিকে ‘দুর্ঘটনা’ না বলে ‘হত্যাকা-’ বলাই হবে যথাযথ। গেটম্যান দায়িত্বশীল হলে এ ঘটনা যে এড়ানো যেত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জয়পুরহাটে বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষের সময় লেভেল ক্রসিংয়ের গেট খোলা ছিল। আর ঘুমিয়েছিলেন গেটম্যান। জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই একজনের ঘুমের কারণে কতজনকে চিরতরে ঘুমিয়ে যেতে হল? কে নেবে এই মর্মন্তুদ মৃত্যুর দায়? উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে-গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও অবহেলাজনিত কারণে ঘটে গেছে অনেক দুর্ঘটনা। এবং তাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম নয়।
অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং অসচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী মনে করা হয়। রেলওয়ের বিশেষজ্ঞদের অভিমত- মূলত তিন কারণে রেল দুর্ঘটনা সংঘঠিত হয়। তন্মধ্যে লেভেলক্রসিং, সিগন্যাল লাইনে ত্রুটি এবং উন্নয়নকাজ চলা অবস্থায় ট্রেন লুপ লাইন অথবা সাইডলাইনে চলে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হতে দেখা যায়। রেল যাতায়াত অনেকটা সাশ্রয়ী, আরাম দায়ক ও নিরাপদ হওয়ায় কারণে অনেকে রেলে ভ্রমন করে থাকেন। সরকারও তার সঠিক কর্ম পরিকল্পনা মোতাবিক রেল উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছে। মেট্রো রেলও চালু হতে যাচ্ছে আমাদের দেশ। ভবিষ্যতে রেলপথ বৃদ্ধিপাবে। সেই তুলনায় নিরাপদ হয়নি রেল যোগাযোগ। রেলপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বা হবে, এখনো স্পষ্ট নয়।
দেশে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় দুই হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং। অনেক জায়গায় কোনো গেঁম্যান নেই। সংকেতবাতি ও যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও নেই। শহরের বাইরে অনেক ব্যস্ততম লেভেলক্রসিং রয়েছে। দুই-একটি স্থানে গেটম্যান আছে, তবে বেশির ভাগ লেভেক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই। মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, গ্রাম্য সড়ক, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে রয়েছে অনেক লেভেল ক্রসিং। ট্রেনের টাইমে অনেক লেভেল ক্রসিং এলাকার সাধারণ মানুষ স্বত:স্ফূর্তভাবে গেটম্যানের কাজ করে। তার পরও অহরহ ট্রেন দুর্ঘটনা হচ্ছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নিয়ে যেতে হলে গেট নির্মাণ, কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের। রেল যোগাযোগ নিরাপদ করার কাজে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
লেখক : প্রাবন্ধিক