অনলাইন ডেস্ক:
টিকা, স্বাস্থ্যবিধি মানা আর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন—এই তিন উপায়কেই এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই তিন কৌশল একই সঙ্গে প্রয়োগের কথাই জোর দিয়ে বলেন দেশি-বিদেশি সব বিশেষজ্ঞ। কিন্তু বাংলাদেশে সব কটিই চলছে ছন্নছাড়া অবস্থায়। না মিলছে প্রত্যাশিত পরিমাণে টিকা, মানুষ না মানছে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি আর না কার্যকর করা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। এর পরিণতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন দেশে বেপরোয়া। এ অবস্থায় করোনা মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ মেনে আগামী সোমবার থেকে সাত দিন সারা দেশে কঠোর লকডাউন কার্যকর করা হবে। আজ শনিবার এ বিষয়ে বিস্তারিত আদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের খবর দেয় সরকার। এরপর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়। এরপর সরকার ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে আবার করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে সরকার এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বিধি-নিষেধ জারি করে। সম্প্রতি সীমান্তে করোনার তীব্র সংক্রমণ শুরু হলে বিভিন্ন জেলায় লকডাউন জারি করা হয়। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখতে কয়েক দিন আগে আশপাশের সাত জেলায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
এমন অবস্থায় করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে বুধবার সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বৈঠক করে কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সব মানুষকে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য ঘরবন্দি রাখার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। আর সেই কৌশলকেই পরামর্শ হিসেবে গ্রহণের জন্য জানিয়ে দিয়েছে সরকারকে। কমিটির সভায় এমন কঠোর পদক্ষেপকেই ‘শাটডাউন’ শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন ওই ‘শাটডাউন’ কেমন হবে, তা নিয়েই চলছে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা ও কৌতূহল। এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার গণমাধ্যমকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন আরোপের তথ্য জানান। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউন কার্যকরের জন্য পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন।
সোমবার থেকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন : আগামী সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া কঠোর লকডাউনে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। শুধু অ্যাম্বুল্যান্স ও চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবে না। গণমাধ্যম এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।
প্রধান তথ্য কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হবে।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রস্তাব : কমিটির সভায় প্রস্তাবিত ‘শাটডাউনের’ রূপরেখা কেমন হবে সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, যাঁরা ওই প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা ‘কারফিউ’ অবস্থার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে জরুরি সেবায় নিয়োজিত ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান, রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের বিপণিবিতান বন্ধ থাকবে। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দোকান-বাজার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খুলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর যৌক্তিক জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হলেই শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আগে যেহেতু সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন কাজ করেও সুবিধা করতে পারেনি, তাই এবার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক কমিটিতে জোর দিয়েই বলা হয়েছে, মাত্র ১৪ দিন যদি কার্যকরভাবে সব কিছু বন্ধ রাখা যায় তবেই সুফল মিলবে। এমনকি আসন্ন ঈদুল আজহা ভালোভাবে কাটানো যাবে। তা না হলে সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং মৃত্যু বাড়বে। একই সঙ্গে ভোগান্তি বাড়বে এবং কোরবানির ঈদ বিপর্যস্ত অবস্থায় কাটাতে হবে।
সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র বলেন, যেহেতু কোনোভাবেই সংক্রমণ মোকাবেলায় নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, কঠোর বিধি-নিষেধ কিংবা লকডাউনও মানুষ মানছে না, জীবন-জীবিকার অজুহাত তুলে সরকারকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দিয়ে সব কিছু খুলে দিতে বাধ্য করছে, এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত টিকারও ব্যবস্থা সরকার করতে পারছে না তাই শেষ ভরসা হিসেবে সংক্রমণ ছড়ানোর প্রধান ক্ষেত্র মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
সূত্রগুলো বলছে, আগে লকডাউন দেওয়া হলেও বিভিন্ন মহল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করে সরকারের কাছ থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাত নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার আগেই খোলার অনুমতি আদায় করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য বলেন, এর আগে গত বছর প্রথম দফা লকডাউনেই ভালো সাফল্য মিলেছিল, কিন্তু পরের কোনো লকডাউনই পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। নানা কারণে মাঝপথে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে হয়েছে। আবার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে যেভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেটাও অন্যরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে না। ফলে প্রতিবারই কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবে দু-এক দিন পরে তা ঢিলে হয়ে যায়।
পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, “সভায় মূলত ‘কারফিউ’ নিয়েই আলোচনা হয়েছে, কিন্তু ওই শব্দটির সঙ্গে যেহেতু অনেক স্পর্শকাতর বিষয় জড়িত থাকে তাই ‘কারফিউয়ের’ সিভিল রূপ হিসেবে ‘শাটডাউন’ শব্দ বলা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে যেভাবেই দেখি না কেন, বাস্তব অবস্থা এখন খুবই খারাপ। যার পরিবারে কেউ মারা যাচ্ছে তারা ঠিকই বুঝতে পারছে, অন্যরা হয়তো বুঝতে পারছে না।’
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু : ‘শাটডাউন’ নিয়ে কৌতূহলের মধ্যেই গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া গেছে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু ১০৮ জনের তথ্য। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টার হিসাবে এই ১০০-এর বেশি লোকের মৃত্যু ছাড়াও নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৬৯ জন। সেই সঙ্গে দৈনিক শনাক্তের হার বেড়ে হয়ে গেছে ২১.২২ শতাংশ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে আট লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ১৩ হাজার ৯৭৬ জন এবং সুস্থ হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার ৫৫৯ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে খুলনায়। ১০৮ জনের মধ্যে ওই বিভাগেরই ২৭ জন। আগের দুই দিনও খুলনায় বেশি মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৫ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, সিলেটে তিনজন, রংপুরে ১০ জন এবং ময়মনসিংহে চারজন মারা গেছে। মৃতদের মধ্যে ৭৫ জন পুরুষ এবং ৩৩ জন নারী।