রমজান পবিত্র, রহমতপূর্ণ ও ফজিলতসমৃদ্ধ মাস। এই মাস শুধু রোজা ও ইবাদতের জন্যই নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসে এটি একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী, বিশেষ করে ১৭ রমজান; একটি স্মরণীয় দিন, যা ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই দিনে সংঘটিত হয়েছে এমন কিছু ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
১. বদরের যুদ্ধ : ইসলাম ও কুফরের প্রথম যুদ্ধ
ইসলামের ইতিহাসে যে যুদ্ধটি সর্বপ্রথম হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছিল, তা হলো বদরের যুদ্ধ। এটি ইসলামের এক মহিমান্বিত অধ্যায়, যা চিরকাল মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান, যা ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বা ‘হক-বাতিলের পার্থক্যের দিন’ নামে আল-কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে।(সুরা : আল-আনফাল, আয়াত : ৪১)বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের সেনাবাহিনী ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যাঁদের মধ্যে নবীন সাহাবিদের পাশাপাশি প্রবীণ ও যুবকরাও অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে অস্ত্রসজ্জা ছিল অত্যন্ত সীমিত—মাত্র তিনটি ঘোড়া, ছয়টি বর্শা, আটটি তলোয়ার ও বাহনের জন্য ৭০টি উট ছিল। অন্যদিকে মক্কার কাফিররা এক বিশাল ও সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার, সঙ্গে ছিল ১০০টি ঘোড়া, ৭০০টি উট এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের পক্ষে বিজয় অসম্ভব মনে হলেও আল্লাহর সাহায্য ছিল তাঁদের সঙ্গে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৮)মুসলমানদের ঈমানের শক্তি ও আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্যের ফলে কাফিরদের বিশাল বাহিনী পরাজিত হলো। যুদ্ধ শেষে কুরাইশ নেতাদের ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়।
অন্যদিকে ১৪ জন সাহাবি শহীদ হন। এই বিজয় মক্কার মুশরিকদের অহংকারকে ধূলিসাত্ করে দেয় এবং ইসলামের প্রসারকে শক্তিশালী করে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৮৩)বদরের যুদ্ধ ছিল কেবল একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং এটি ছিল ঈমান ও আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস, যা চিরকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
ইসলামী ইতিহাসের সূর্যালোকে এক অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী এবং প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কন্যা।
তাঁর নাম আয়েশা, উপাধি সিদ্দিকা ও হুমায়রা এবং তাঁর সম্মানজনক উপাধি উম্মুল মুমিনিন (মুমিনদের জননী)। আয়েশা (রা.) ছিলেন মেধা, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রখ্যাত সাহাবি আবু মুসা আশআরি (রা.) বলেন, ‘আমরা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা, যখনই কোনো জটিল বিষয়ে সমস্যায় পড়তাম, তখনই আয়েশা (রা.)-এর শরণাপন্ন হতাম। তাঁর কাছে এমন কোনো বিষয় ছিল না, যার সমাধান তিনি জানতেন না।’ (জামে আত-তিরমিজি : কিতাবুল মানাকিব, হাদিস : ৩৮৮৩)তাঁর প্রজ্ঞা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কারণেই তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান মুহাদ্দিস, যাঁর মাধ্যমে বহু হাদিস সংকলিত হয়েছে। তিনি প্রায় দুই হাজার ২০০-এরও বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা ইতিহাসের পাতায় অমূল্য ভাণ্ডার হয়ে রয়েছে। আয়েশা (রা.) ছিলেন ইবাদত ও আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক। তিনি বেশির ভাগ সময় রোজা রাখতেন এবং রাতের বেশির ভাগ অংশ নফল নামাজে অতিবাহিত করতেন।
তাঁর অন্তর ছিল দানশীলতায় পরিপূর্ণ। উমর (রা.) তাঁর জন্য একটি ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। একবার তিনি ৬০ হাজার দিরহাম সদকা করে দেন অথচ নিজে মাত্র দুটি খেজুর খেয়ে দিন অতিবাহিত করেন। (সিরাতে রাসুল,খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১১৪)
৫৮ হিজরি সনের পবিত্র রমজান মাসে আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার সময় যখন লোকেরা তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতেন, তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৫৮)
অবশেষে ১৭ রমজান, ৫৮ হিজরি সালে রাতের বেলায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান প্রখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়। (আল মুজামুল কাবির, খণ্ড-২৩, পৃষ্ঠা-২৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪২৬)