অনলাইন ডেস্ক:
কলকাতার এককালের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’-এর সম্পাদক জলধর সেন সম্পর্কে বাজারে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার এক ব্যক্তি জলধর সেনের কাছে একটি লেখা নিয়ে এসেছেন। লেখার বিষয় ‘সমাজে চোরের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের দমনের উপায়।’ জলধর বাবু লোকটি কে তা চেনেন। তাঁরই পাড়ার লোক। শিক্ষিত চোর। মাসখানেক হয় চুরির দায়ে জেল খেটে এসেছে। জলধর বাবু লেখাটি হাতে নিয়ে হাসতে শুরু করলেন। লোকটি জিজ্ঞেস করল, লেখাটি ছাপবেন? জলধর বাবু হাসতে হাসতেই বললেন, ‘দাঁড়াও বাপু, একটু হেসে নিই। বহুদিন কাজের চাপে হাসি না। আজ তুমি আমাকে হাসার সুযোগ দিলে।’
বহুদিন আগে পড়া গল্পটি মনে পড়ল ঢাকার একটি দৈনিকে একটি খবর দেখে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিনের একটি বিবৃতি পাঠ করে। তিনি ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সভায় বলেছেন, ‘সরকার পরিবর্তনে জনগণ তার ভোটাধিকার ফিরে না পেলে বাংলাদেশে আফগানিস্তানের মতো তালেবান রাজনীতির উত্থান ঘটবে।’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই সভায় উপস্থিত থাকলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাহেবের বক্তৃতা শুনে কলকাতার জলধর সেনের মতো আমাকেও বেদম হাসতে হতো।
একটি সদ্যঃপ্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে অবৈধভাবে দখল করে যাঁরা আধা পাকিস্তান বানিয়েছেন, তারপর পুরো তালেবান রাষ্ট্র করার চক্রান্ত করেছিলেন, যাঁরা সংবিধান থেকে অবৈধভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করেছেন, তাঁদের একজনের মুখে দেশে তালেবান রাজনীতির উত্থানের কথা শুনলে হাসি চেপে রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব কি? এ তো ভূতের মুখে রামনাম।
মেজর হাফিজ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। তিনি নিজেই যে এখন একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র হারিয়েছেন এবং বাংলাদেশের তালেবান শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন তা সম্ভবত বুঝতে পারছেন না। তাঁকে একটা গল্প বলি। ফ্রান্সের মার্শাল পেঁতা ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। ভার্দুন যুদ্ধে তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করে ভার্দুন বিজয়ী মার্শাল পেঁতা—এই নামে অভিহিত হয়েছিলেন। প্যারিসে ভার্দুন ওয়ার মেমোরিয়াল নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে তাতে মার্শাল পেঁতার একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল। প্যারিসে এই জাদুঘরটি এখনো আছে। কিন্তু পেঁতার ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়েছে।
কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির হিটলার বাহিনী যখন ফ্রান্স আক্রমণ ও দখল করে তখন পেঁতা তাদের কোলাবরেটর হন এবং তাঁবেদার সরকার গঠন করেন। ফ্রান্সে নাৎসিদের শাসন উচ্ছেদ হওয়ার পর পেঁতা দেশদ্রোহী হিসেবে আদালতে বিচারের জন্য সোপর্দ হন। আদালত তাঁর বয়স বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। আদালতে বিচার চলাকালে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মার্শাল পেঁতা বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ ও নাৎসিদের সঙ্গে কোলাবরেশনের অভিযোগ আনার আগে আদালতকে বিবেচনা করতে হবে আমি দেশপ্রেমের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপ্ত ভার্দুন বিজয়ী মার্শাল পেঁতা। আদালত তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মার্শাল, আপনি এখন আর সেই ভার্দুন বিজয়ী খেতাবের অধিকারী নন। আপনি একজন ঘৃণ্য দেশদ্রোহী। দেশদ্রোহী হিসেবেই আপনার বিচার হচ্ছে।’
মেজর হাফিজকেও সবিনয়ে জানাই, বিএনপি-জামায়াত জোটে ঢোকার পর তাঁর পরিচয় আর একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা নয়; তাঁর পরিচয় পঁচাত্তরের ঘাতক দলের নেতা। যে দলের মূল নেতার হাতে জাতির পিতার এবং অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্ত লেগে আছে। বিএনপি যে জামায়াত দলের চির সখা ও মিত্র, তাদের মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘বাংলা হবে আফগান/আমরা সবাই তালেবান।’
মেজর হাফিজের দলের রাজত্বকালে আফগান যুদ্ধে পরাজিত তালেবানের একটি বড় অংশ পাকিস্তানে এসে আস্তানা বাঁধে। এই তালেবান দমনের জন্য যখন মার্কিন সরকার পাকিস্তানের ওপর চাপ দেয়, তখন এই তালেবানের একটা অংশকে জাহাজযোগে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসার কাজে সাহায্য জোগায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। ফরাসি দৈনিক লা মঁদে, ওয়াশিংটন পোস্ট ইত্যাদি বড় কাগজে বাংলাদেশে পলাতক তালেবানের আস্তানা গাড়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো তালেবান আশ্রয় নিচ্ছে না, শেখ হাসিনা মিথ্যা প্রচার দ্বারা দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন।’ খালেদা জিয়ার বক্তব্য সমর্থন করে একই দিনে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক বলেছিল, খালেদা জিয়ার দাবি সত্য। শেখ হাসিনা বিদেশের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন।
তারপর বেশিদিন যায়নি, বাংলাদেশে তালেবানের সন্ত্রাস শুরু হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। বাংলা ভাই, শায়খুল হাদিসরা আবির্ভূত হন। উত্তরবঙ্গে বাংলা ভাইরা ‘নরমুণ্ড’ শিকার শুরু করেন। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দলের নেতাকে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবার আর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো মহলকেই কান্নাকাটি করতে দেখা যায়নি।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এমন কী করেনি, যাতে দেশটির তালেবান দেশ হতে বাকি ছিল? বিএনপির সহযোগী দল জামায়াত হাজার হাজার মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাইতে দেয় না, জাতীয় পতাকা তুলতে দেয় না। জাতির পিতার নামোচ্চারণ করতে দেয় না। বিএনপি তার শাসনামলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলা উচ্চারণ করতে দেয়নি। জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীদের বিচার করেনি। বরং সরকারি উচ্চ পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করেছে। মেজর হাফিজের নেতা তারেক রহমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, একাত্তরের গণহত্যার সহযোগী জামায়াত তাঁদের পরিবারের অংশ।
দেশে বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন বাংলা ভাইয়ের আবির্ভাব ও অত্যাচার শুরু হয়, তখন খালেদা জিয়ার একজন মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘দেশে বাংলা ভাইটাই বলে কেউ নেই। সব মিডিয়ার তৈরি।’ এর কিছুদিন পরই মার্কিন এফবিআই সন্ত্রাস দমন তদন্তে বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলা ভাই, শায়খুল হাদিস প্রমুখ ঘাতক ও সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রমাণ পান। মেজর হাফিজের দলের সরকার প্রকাশ্য মার্কিন চাপেই বাংলা ভাইদের ফাঁসি দিতে বাধ্য হয়। তখন কেউ খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করেনি, আপনার মন্ত্রী বলেছেন, বাংলা ভাই বলে দেশে কেউ নেই, তাহলে ফাঁসি দিলেন কাকে? কোনো ভূতকে কি?
এখন মেজর হাফিজকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, একাত্তরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বুকে হাত দিয়ে বলুন, ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে না এলে দেশটার অবস্থা কী হতো? আধা তালেবান দেশ হওয়া থেকে পূর্ণ তালেবান দেশ কি হতো না? দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে বিরাট জনগোষ্ঠী বিশ্বাসী তারা এই অবস্থা মেনে নিত না। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হতো। এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে ইরাক ও সিরিয়ার মতো ইসলামী স্টেট বা তথাকথিত খেলাফত রাষ্ট্রের সন্ত্রাসীরা এসে বাংলাদেশেও ঘাঁটি গাড়ত।
এই গৃহযুদ্ধে আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশ ধ্বংস হতো, আর এই গৃহযুদ্ধ থামানোর নামে মার্কিন মেরিন আসত বাংলাদেশে। ভারতীয় সেনা আসাও অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। এবার ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে এলে আর বন্ধুর ভূমিকায় আসত না।
বলুন মেজর হাফিজ, বুকে হাত দিয়ে বলুন, এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা দেশটাকে বাঁচাননি? এখনো বাঁচিয়ে চলছেন না? দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সত্ত্বেও। মেজর হাফিজ, আপনারা দয়া করে জবাব দিন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগই এখন দেশের বিকল্পহীন শক্তি নয়, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লুট হয়ে যেতে দেননি, এখনো দিচ্ছেন না?
লেখক: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী,লন্ডন, সোমবার, ৩১ মে ২০২১