অনলাইন ডেস্ক:
ধর্মের নামে, পবিত্রতার নামে এত কিছু বলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক পার্লারে কাজ করা এক নারীকে নিয়ে সোনারগাঁয় রিসোর্টে বিনোদন করতে গিয়ে ধরা পড়েন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে হেফাজতের সাম্প্রতিক তাণ্ডবের চিত্র জাতীয় সংসদে তুলে ধরে তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হেফাজতের তাণ্ডবের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের মদদ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গতকাল রবিবার একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। শনিবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় একটি রিসোর্টের ভেতর এক নারীসহ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এরা একদিকে ইসলামের নাম, ধর্মের নাম, পবিত্রতার নাম… এত কিছু বলে যত অপবিত্র কাজ করে আজকে ধরা পড়ে সোনারগাঁয় একটা রিসোর্টে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা রিসোর্টে ধরা পড়ে হেফাজতের জয়েন্ট সেক্রেটারি। সে ধরা পড়ল। এখন সেটা ঢাকার জন্য নানা রকম চেষ্টা। পার্লারে কাজ করে এক মহিলা। যাকে আবার এখন এদিকে তার বউ হিসেবে পরিচয় দেয়, আবার নিজের বউয়ের কাছে বলে যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এটা বলে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, ‘যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, এই রকম মিথ্য কথা, অসত্য কথা তারা বলতে পারে কি না। তারা তো বলতে পারে না। তাহলে এরা কী ধর্ম পালন করে? মানুষকে কী ধর্ম শেখাবে? তাই হেফাজতের যারা সদস্য, তাদেরও আমি অনুরোধ করি, তারাও একটু বুঝুক কোন নেতৃত্ব তাদের? আগুন জ্বালাও, পোড়াও করে তিনি বিনোদন করতে গেলেন একটা রিসোর্টে একজন সুন্দরী মহিলা নিয়ে—এটাই তো বাস্তবতা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরা ইসলাম ধর্মের নামে কলঙ্ক। ইসলামকে তারা ছোট করে দিচ্ছে। কিছু লোকের জন্য আজকে এই ধর্মটা জঙ্গির নাম, সন্ত্রাসের নাম। এখন তো যেই চরিত্র দেখাল, তাতে দুশ্চরিত্রের নামও জুড়ে দিচ্ছে। তার মানে আমার যে পবিত্র ধর্ম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম, যে ইসলাম ধর্ম সহনশীলতা শিখিয়েছে, শান্তির কথা বলেছে, সাধারণ মানুষের কথা বলেছে, মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছে—সেই পবিত্র ধর্মকে এরা কলুষিত করে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করেছে এবং এত অর্থ কোথা থেকে আসে এই বিনোদনের, সেটাও একটা প্রশ্ন। এটা দেশবাসী বিচার করবে। আর আইন তার আপন গতিতে চলবে। সেটুকু আমি বলতে চাই।’
আগুন নিয়ে খেলছে তারা
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপনের মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে হেফাজতের চালানো তাণ্ডবের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে, সেই সময় যে ঘটনাগুলো এখানে ঘটানো হলো, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় যে যেখানে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী আমরা উদযাপন করছি, সেই সময়… হ্যাঁ আমাদের অনেক বিদেশি অতিথি আসছেন; অনেকে বার্তা দিচ্ছেন। সেই ব্রিটেনের রানি থেকে শুরু করে, সৌদি আরবের বাদশা থেকে শুরু করে সবার বার্তা আমরা পাচ্ছি—এত বড় একটা সম্মান বাংলাদেশ পাচ্ছে, সেখানে কারা খুশি হতে পারলেন না?’
কওমি মাদরাসা দ্বারা প্রভাবাধীন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আজকে হেফাজতে ইসলাম কর্মসূচি দেয়, তারা কি দেওবন্দে যায় না শিক্ষা গ্রহণ করতে? তাই এই সব ঘটনা যদি ঘটায়, তাহলে উচ্চশিক্ষায় দেওবন্দ যাবে কিভাবে? সেটা কি তারা একবারও চিন্তা করেছে।’
শিক্ষা সনদ, পাঠক্রম নির্ধারণ ও দেশে-বিদেশে চাকরির ব্যবস্থাসহ কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তার পরও তারা এই তাণ্ডবটা কেন ঘটাল? তাদেরকে… প্রথমেই আমরা দেখলাম কি বিএনপি তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট কিভাবে সমর্থন দিচ্ছে, সেটাই আমার প্রশ্ন। হেফাজত তো একা না, হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপিও জড়িত এবং তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই তো দেখা যায়। হেফাজতের সকলেই যে এর মধ্যে জড়িত তাও কিন্তু নয়, এটা হলো বাস্তবতা।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমার প্রশ্ন, ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মের নামে এই যে জ্বালাও-পোড়াও, এটা কিভাবে আসলো? তবে এটা নতুন কিছু না, ২০১৩ সালে আমরা দেখেছি এই বিএনপি-জামায়াত কিভাবে চলন্ত গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষকে পুড়িয়েছে, কিভাবে মানুষের ওপর আক্রমণ করেছে, সেগুলো আমরা দেখেছি।’
‘হেফাজতে ইসলাম আগুন নিয়ে খেলছে’ মন্তব্য করে তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক ঘরে আগুন লাগলে তো সেই আগুন অন্য ঘরেও চলে যেতে পারে। সেটা কি তাদের হিসাবে নেই? আজকে রেলস্টেশন থেকে শুরু করে, ভূমি অফিস থেকে শুরু করে, ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সব জায়গায় যে আগুন দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের মাদরাসা, তাদের বাড়িঘর—সেগুলোতেও যদি আগুন লাগে তখন তারা কী করবে? জনগণ কি বসে বসে এগুলো শুধু সহ্য করবে? তারা তো সহ্য করবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে কেউ কেউ বলছেন পুলিশ কেন ধৈর্য দেখিয়েছে? আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি, এগুলো বিরত করার চেষ্টা করেছি। কারণ সংঘাতে সংঘাত বাড়ে, আমরা তা চাইনি। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ভালোভাবে উদযাপন করতে চেয়েছি। কিন্তু যারা এসব অপকর্ম করেছে, দেশবাসীই এটার বিচার করবে, দেশবাসী দেখবে যে এদের চরিত্রটা কী?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একজন মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানের জান-মাল হেফাজত করা, রক্ষা করা হচ্ছে তাদের দায়িত্ব। আর হেফাজতের নামে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে যাচ্ছে। আর বিএনপি-জামায়াত হচ্ছে তাদের মদদদাতা। এই লজ্জা শুধু বাংলাদেশের জনগণের না, বিশ্বব্যাপী এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। পুরো পৃথিবীতেই মুসলমানদের জন্য এটা লজ্জার বিষয় এনে দিচ্ছে তারা। এটাই হচ্ছে আমাদের দুঃখ যে, আমাদের যে পবিত্র ধর্মটা, সেই ধর্মটাকে তারা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে।’
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার আহ্বান
সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এক সপ্তাহ লকডাউনের আদলে বিধি-নিষেধ ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। আজই (রবিবার) আমি প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছি। হয়তো মানুষের একটু কষ্ট হবে, কিন্তু মানুষের জীবনটা তো আগে। আগে জীবনটা বাঁচাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সব কিছু আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আমরা টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু করব। আরো টিকা আনা হবে, টিকা আনার ব্যবস্থা করব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘হয়তো মানুষের একটু কষ্ট হবে, কিন্তু মানুষের জীবনটা আগে বাঁচাতে হবে। গত ২৮ থেকে ৩০ মার্চ হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেল। এর পর থেকে বাড়া অব্যাহত রয়েছে। আমরা প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি, এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছি। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করছি।’