Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
এক খাঁটি বাঙালি
--ফাইল ছবি

এক খাঁটি বাঙালি

অনলাইন ডেস্ক:

বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিকে চেতনার মর্মমূলে ধারণকারী এক খাঁটি বাঙালি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র মতো অমর সংগীতের রচয়িতা তিনি। এই গানটি তাঁকে এনে দিয়েছে ভুবনজয়ের খ্যাতি। জীবদ্দশায় নিজের লেখা গানের জন্য এত খ্যাতি খুব বেশি মানুষের ভাগ্যে জোটেনি।

শুধু এ গান রচনাই নয়, গত পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাসে বাংলার বুকে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ সব ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে তাঁর। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ লিখে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার। সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে পরিণত হন কিংবদন্তিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরব ছিলেন প্রগতিশীলতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে; অসাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখলেই তিনি ক্ষুরধার এগিয়ে এসেছেন। জোরালো যুক্তি, ইতিহাসের তথ্য ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ানে আঁধার ঠেলে জাতিকে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর, জন্মস্থান বরিশালের উলানিয়ায়। উলানিয়া মাদরাসা, আসমত আলী খান ইনস্টিটিউট, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলজীবনে যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতির সঙ্গে। বরিশাল শহরের তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী স্বদেশ বসুর সান্নিধ্য তাঁর রাজনীতির অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়। শুধু তা-ই নয়, শৈশবের সোনালি উষার উত্তাপ মাখা বছরগুলোতে শিক্ষক মৌলভী আহমদের সংস্পর্শ স্বদেশ ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চেতনায় যে বীজ রোপিত হয়েছিল, তা সারা জীবন তাঁকে প্রভাবিত করেছে। মানবতার দীক্ষাও সর্বপ্রথম এই মৌলভীর কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ‘মৌলভী আহমদের কাছেই প্রথম শিখেছি আমরা বাঙালি এবং বাংলাদেশকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। তাঁর কাছেই হয়েছিল মানবতাবাদী চেতনায় আমার প্রথম দীক্ষা গ্রহণ। ’ ১৯৫৫ সালে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে, এ সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ছিলেন ফজলুল হক হল ছাত্রসংসদের সদস্য। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের স্বাধিকার সংগ্রাম এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কর্মজীবন শুরু ১৯৪৭ সালে, সেটা করেছিলেন দুর্গামোহন সেন সম্পাদিত কংগ্রেসহিতৈষী পত্রিকায় চাকরির মাধ্যমে। তারপর দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, সওগাত, দিলরুবা, ইত্তেফাক, আজাদ, মোহাম্মদী, সোনার বাংলা, পূর্বদেশ, জয় বাংলা, জাগরণ ইত্যাদি পত্রিকায় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্পাদনা করেছেন নকীব, চাবুক, জনপদ, নতুন দিন  ইত্যাদি পত্রিকা। কলাম লিখেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পত্রিকায়। অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর কলম সব সময় সচল ছিল।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন। তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে যোগ দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের গায়েবানা জানাজা শেষে শোক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে পুলিশি নির্যাতনে মারাত্মকভাবে আহত হন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে কিছুদিন এখানে-ওখানে থাকার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হই। কারণ পায়ের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। গোড়ালি ফুলে উঠেছিল। হাঁটতে পারতাম না। এক মাস ছিলাম হাসপাতালে। ’  ১৯৫৫ সালের শহীদ দিবস পালন করতে গিয়েও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। গ্রেপ্তার করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান একুশের গান রচনার।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিনের রক্তাক্ত দেহ দেখে তাঁর স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রচনা করেছিলেন একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, যেটি স্বীকৃতি পেয়েছে প্রভাতফেরির অমর সংগীত হিসেবে। গানটি প্রথমে আব্দুুল লতিফ কর্তৃক সুরারোপ করা হলেও পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাভাষী তো বটেই, অন্য ভাষার মানুষদের কাছেও এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে ঢাকা কলেজের ছাত্রসংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। একই বছর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে এটি স্থান পায়। ১৯৫৪ সাল থেকে লাভ করে প্রভাতফেরির গানের মর্যাদা। ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে এই গানের মোহনীয় সুর ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এটি শুধু একুশের গান হিসেবে নয়, বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্মারক হিসেবেও লাভ করে গুরুত্ব। বিবিসির শ্রোতা জরিপে গানটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থান লাভ করে। বর্তমানে হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশসহ ১৫টি ভাষায় এই গান গাওয়া হয়। এটি ছাড়াও আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী একুশের চেতনার স্মারকবাহী আরো কয়েকটি গান রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো—‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/আমি কি ভুলিতে পারি/একুশে ফেব্রুয়ারি?’ ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা। ’

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য বিমুখতা দেখে পীড়া অনুভব করে তিনি লিখেছেন : ‘পৃথিবীর সব দেশে মানুষ স্মৃতি সংরক্ষণ করে। আমরা ভাঙি। আমরা বাঙালিরা যেন আমাদের সব অতীত, ঐতিহ্য, স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেই খুশি হই। ’ ইতিহাস বিকৃতিকারীদের আস্ফাালন দেখেও তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সময় সময় পাল্টা যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করে ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখনই বাঙালি জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, তখনই তিনি কলম হাতে তুলে নিয়েছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর বাঙালিত্বের ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে। বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ছাত্রজীবনেই। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বরিশালের সাপ্তাহিক নকীব পত্রিকায় গল্প-প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা (১৯৯৪), পলাশী থেকে ধানমণ্ডি, আমরা বাংলাদেশী না বাঙ্গালী ইত্যাদি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), স্বাধীনতা পুরস্কারসহ (২০০৯) নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর চিন্তা-চেতনা বাঙালিকে উজ্জীবিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাদের দীপ্তিতে করে ভাস্বর। তাঁর কলাম ও সাহিত্য জাতির চেতনায় প্রজ্বালিত করে বাঙালিত্বের চিরায়ত অগ্নিমশাল। জীবনের শেষ ৪৬ বছর দূর প্রবাস লন্ডনে বসবাস করলেও কখনো শিকড়ের টান থেকে দূরে থাকেননি। গত ১৯ মে তাঁর কলম চিরতরে থেমে গেছে। এই কীর্তিমান লেখক ও খাঁটি বাঙালির স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply