Monday , 25 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
এক-এগারোর দিনগুলোতে খালেদা ছিলেন অসহায়

এক-এগারোর দিনগুলোতে খালেদা ছিলেন অসহায়

অনলাইন ডেস্ক:

কয়েক দিন আগেও যে নারী বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, তাঁকেও যে সন্তানের মুক্তির জন্য একজন ভিনদেশি রাষ্ট্রদূতের হস্তক্ষেপ চাইতে হবে, এ বিষয়টি খুবই নাড়া দিয়েছিল ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসকে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস থেকে অবসরে যাওয়ার পর দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক ‘কথ্য ইতিহাস প্রকল্পকে’ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্মরণ করেছেন এক-এগারোর সেই দিনগুলোর কথা।

প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকের সময় থেকে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম কয়েক মাস তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস বলেন, ‘হয়েছে। কিন্তু যথেষ্ট চেষ্টা করেও আমি অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হই।’

উদাহরণ হিসেবে বিউটেনিস জানান, বাংলাদেশে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র উপস্থাপনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এ দেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কয়েকজন ব্যক্তির প্রতি তিনি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে জনগণের সামনে আসবেন। তাঁর অফিসের কর্মীরা তাঁকে একই দিনে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও জিয়াউর রহমানের সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ীই তিনি এক এক করে দুই জায়গাতেই একই দিনে গিয়েছিলেন। কিন্তু এর ফল খুব একটা ভালো হয়নি। বিএনপি মনে করেছিল, শেখ হাসিনার পরিবার সেই সম্মান প্রাপ্য নয়। কারণ শেখ হাসিনা তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল প্রথমে জিয়ার সমাধিতে যাওয়া নিয়ে। শুরুতেই এমন অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশে বড় দুই দলের নেতাদের ব্যাপারে সমান আচরণ করা কতটা কঠিন। কারণ তারা পরস্পরকে সমান হিসেবে দেখে না।

বিউটেনিস বলেন, ঢাকায় যাওয়ার পরপরই মনে হয়েছে যে এখানে সবাই তাঁকে রাজনীতিতে জড়ানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে বুঝতে পেরেছেন যে এ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কতটা। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতারা অব্যাহতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং তাঁদের অবস্থানের বিষয়ে কোনো না কোনো সমর্থন-সহযোগিতা চাইতেন। এমনটি সব দেশে হয় না। বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রায় সফল হলেও রাজনৈতিকভাবে তখনো অগ্রগতির পথে। তখন বাংলাদেশ অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রপন্থী। তাই নেতারা তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইতেন। আর এ নিয়ে সব সময় তাঁকে সতর্ক থাকতে হতো। বাংলাদেশে থাকার কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন তিনি।

বিউটেনিসের মতে, ‘ভারতে সরকারের সঙ্গেও আমাদের অনেক অংশীদারি আছে। কিন্তু সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা খুব সজাগ থাকেন যেন তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের খুব কাছের মনে না হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক আলাদা। এখানে সবাই তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে আমেরিকানদের সঙ্গে দৃশ্যমান থাকতে চায়।’

‘বাংলাদেশে রাজনীতি শুধু খেলা নয়, বিদ্বেষপূর্ণ খেলা’—সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস বলেন, ‘অনেকটাই এমন। রাজনৈতিক দলগুলোর পেশিশক্তি দেখানোর লোক আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আদর্শিক খুব পার্থক্য নেই, অন্তত দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে।’

বিউটেনিস বলেন, অব্যাহতভাবে তাঁকে শুনতে হতো যে তিনি নিরপেক্ষ নন। আর তিনিও অব্যাহতভাবে বলতেন, ‘আমরা কোনো নির্দিষ্ট কাউকে বা প্রার্থীকে সমর্থন করছি না।’

বিউটেনিস স্মরণ করেন, বিএনপি তখনো ক্ষমতায়। তারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার ব্যবস্থা করছে। এমন সময় তাঁর বাসায় ফোন বেজেই চলেছে। সব রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম সবাই তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। অন্য মিশনপ্রধানদের ফোনেরও একই অবস্থা।

বিউটেনিস বলেন, একপর্যায়ে মনে হলো, ‘অদ্ভুত। আপনারা (বাংলাদেশিরা) নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করুন। আমি মনে করি না, নিজেদের রাজনীতির মধ্যে বিদেশিদের ডেকে আনা ভালো কোনো ভাবনা। অন্য সরকারগুলো আমাদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আনে। আর এখানে (বাংলাদেশে) লোকজন কী করবে, তা যেন আমরা ঠিক করে দিই সে জন্য তারা আক্ষরিক অর্থেই দাবি জানায়।’

সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘সহযোগিতার জন্য আমি আরেকটি অনুরোধ পেয়েছিলাম। আগে যেমন বলেছিলাম, সামরিক বাহিনী এ সময়টাকে (এক-এগারো) দেশের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। দুর্নীতির অভিযোগে তাদের অন্যতম টার্গেট ছিলেন খালেদা জিয়ার ছেলে ও দৃশ্যত তাঁর উত্তরাধিকারী তারেক রহমান। তিনি (তারেক রহমান) তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন এবং লোকজন তাঁকে ভয় পেত। একদিন আমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ পেলাম। যেহেতু শেখ হাসিনা ও অন্য দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আমার অব্যাহতভাবে দেখা হচ্ছে, আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করতে রাজি হলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পাঁচতারা একটি হোটেলে গেলাম। সেখানেই বিএনপি ওই দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল।’

বিউটেনিস বলেন, খালেদা জিয়া একটি কক্ষে তাঁর পুত্রবধূর (তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান) সঙ্গে বসে ছিলেন। তারেকের স্ত্রীর সঙ্গে আমার আগেও দেখা হয়েছিল। বিউটেনিস বলেন, ‘খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর ছেলেকে কারাগার থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করি। বিষয়টি এমন যেন আমার সেই ধরনের প্রভাব আছে। আমি চেষ্টা করিনি। আমার সেই প্রভাব থাকলেও আমি চেষ্টা করতাম না। আবারও বলব, আমাদের অবস্থান ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তাদের সামরিক সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানানো, যেন বন্দিদের মানবাধিকার ও আইনি প্রক্রিয়াকে সম্মান করে।’

বিউটেনিস বলেন, ‘খালেদা জিয়া যদি সেদিন দাবি করতেন যে তারেককে নির্যাতন করা হচ্ছে; আমি সেই দাবি সরকারকে জানাতাম। কিন্তু তিনি সেই দাবি করেননি।’ বিউটেনিস আরো বলেন, ‘আমি হস্তক্ষেপ করতে পারিনি। তবে আমি তাড়িত হয়েছিলাম এটি ভেবে যে এই অনুরোধ জানানো তাঁর (খালেদা জিয়া) জন্য কতটা অবমাননাকর। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতাবান সেই নারী বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের অবস্থানকে অনেকটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। আর এখন তিনি তাঁর সন্তানকে মুক্ত করতে আমাকে বলছেন। আমার স্মরণ আছে, সেদিন আমাদের তিনজনের মধ্যে (খালেদা জিয়া, জোবাইদা রহমান ও বিউটেনিস) কঠিন আলোচনা হয়েছিল।’

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply