অনলাইন ডেস্ক:
রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে হত্যার ঘটনায় হাসপাতালটির চার অংশীদারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন নামের এই চার পরিচালক গাঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁদের গ্রেপ্তারে একাধিক দল অভিযান চালাচ্ছে।
গ্রেপ্তারকৃত দুই পরিচালকের মধ্যে আরিফ মাহমুদ জয় ৯ কর্মচারীর সঙ্গে সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। আর গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হলেও অসুস্থতার কারণে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ওই হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় অবজারভেশনের নামে যে সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে আনিসুলকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়, সেখানেই নেওয়া হতো সব রোগীকে। মানসিক সমস্যায় রোগী কোনো প্রকার অবাধ্য হলেই চালানো হতো নির্যাতন। আটকে রাখা হতো দীর্ঘ সময়। রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য জানিয়েছেন আসামিরা।
এদিকে পরিদর্শনকারী দলের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার ওই হাসপাতালে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
এদিকে আনিসুলের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হলেও পরবর্তী সময়ে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বিভাগীয় মামলায় আনিসুলের পদোন্নতি আটকে যায়। এ ছাড়া সততার সঙ্গে জীবন যাপন করা নিয়ে ‘তিরস্কার’ ও ‘পারিবারিক কিছু অশান্তির’ কারণে চরম হতাশায় পড়েন আনিসুল। এই হতাশা থেকেই সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
গতকাল দুপুরে গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার, ঢাকার তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন-অর-রশিদ এবং আনিসুলের ৩০-৩৫ জন ব্যাচমেট (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা) গাজীপুরে তাঁর বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের কাছে পেয়ে আনিসুলের স্ত্রী, বাবা, ভাই-বোন কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের সান্ত্বনা দেন। নিজেরাও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। অঝোরে কাঁদতে থাকেন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।
নিহত আনিসুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহমেদ সন্তান হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে প্রধানমন্ত্রী ও আইজিপির হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ সময় কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খান ও গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রীনা পারভীন উপস্থিত ছিলেন। পরে তাঁরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে নিহতের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারত করেন।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘এএসপি আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অভিযোগপত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে দেওয়া হবে।’
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, ঘটনার পরেই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া হাসপাতালের মালিক ও মার্কেটিং ম্যানেজার জয়কে ৯ কর্মচারীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতাল থেকে অন্য মালিক নিয়াজ মোর্শেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি প্যারালাইজড হওয়ায় ওই হাসপাতালেই তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এজাহারনামীয় ১৫ আসামির মধ্যে হাসপাতালের চার অংশীদার (মালিক) এখনো পলাতক রয়েছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে একে অন্যের ওপর হত্যার দায় চাপাচ্ছেন। তবে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সাউন্ডপ্রুফ কক্ষটি নির্যাতনে ব্যবহার হয় বলে স্বীকার করেছেন তাঁরা। কোনো মানসিক রোগী তার সমস্যার কারণে অবাধ্য হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়ে ওই কথিত অবজারভেশন কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। রোগী অচেতন হয়ে পড়লে তাকে বেডে নেওয়া হতো। এএসপি আনিসুলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতাল পরিদর্শন করে ডিএনসির কর্মকর্তাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অধিশাখা হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল করেছে। ডিএনসির অতিরিক্ত মহাপরিচালক সঞ্জয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘এই ঘটনায় নিরাময়কেন্দ্রের অনিয়মের বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছি। সব প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।’
পরিবারঘনিষ্ঠ ও বন্ধুদের একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা জেলার সাভার সার্কেলের দায়িত্বে থাকার সময় আনিসুল করিম শিপনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বিভাগীয় প্রসিডিং হয়; যার কারণে তাঁর পদোন্নতি আটকে যায়। ছয়-সাত মাস আগে তাঁকে বরিশাল বিভাগের মুলাদী সার্কেলে বদলি করা হয়। সেখান থেকে কিছুদিন আগে বদলি করা হয় বরিশাল মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে। পোস্টিংয়ের জন্য কখনো তদবির করেননি তিনি। সৎ ও কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা আনিসুলের নিজের বাড়ি, ফ্ল্যাট বা গাড়িও নেই। গাজীপুর শহরের বরুদা এলাকার পৈতৃক বাড়িটিও টিনশেড বিল্ডিং।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শারমীন সুলতানাকে বিয়ে করেছিলেন আনিসুল। স্ত্রী ও চার বছরের ছেলে সাফরানকে নিয়ে তাঁদের সংসার সুখেই চলছিল। বাবা ও ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্কও ছিল মধুর। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা শ্বশুর ও শাশুড়ির অপছন্দের ছিল আনিসুলের বাবা ও ভাই-বোনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। ক্যাডারে প্রথম হলেও পদোন্নতি না পাওয়াসহ কিছু বিষয়ে ‘তিরস্কার’ শুনতে হয়েছে তাঁকে। বরিশালে বদলি এবং পারিবারিক কিছু টানাপড়েনে সম্প্রতি প্রচণ্ড হতাশায় ভুগছিলেন আনিসুল।
জানতে চাইলে বাল্যবন্ধু ডা. মোস্তফা মাহমুদ রুবেল হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি করে বলেন, খুবই মেধাবী ছিলেন শিপন। ক্লাসে শিপন ছিলেন সেকেন্ড, তিনি থার্ড। ছাত্রজীবনে ছিলেন ক্রিকেটপ্রেমী। ছিলেন অলরাউন্ডার এবং তাঁদের বরুদা দুর্বার ক্লাবের ক্যাপ্টেন। ঘরভর্তি তাঁর ক্রিকেটের ক্রেস্ট-মেডেলে। চাকরিতে যোগদান করেও দুই-তিন বছর আগে বাড়ি এসে রাজবাড়ী মাঠে সিনিয়র বনাম জুনিয়র একাদশের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছিলেন শিপন।
বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহমেদও ছিলেন পুলিশের এসআই। তিনিও ছিলেন সৎ মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি বলেন, ‘সুস্থ করার জন্য ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কয়েক মিনিট পরই সে লাশ হয়ে গেল। এই কষ্ট কিভাবে সইব!’
এলাকাবাসীর মানববন্ধন : এএসপি আনিসুল হত্যার ঘটনায় গাজীপুরের মানুষ, সহপাঠী ও স্বজনসহ সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। গতকাল সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্থানীয় স্কুল ও কলেজে তাঁর সহপাঠী এবং এলাকাবাসী হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে। কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূইয়া, আয়েশা বেগমসহ আওয়ামী লীগের এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেয়। এ সময় বক্তারা অবিলম্বে শিপন হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রসঙ্গত, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে গত সোমবার রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার টর্চার সেলে মারধরে তাঁর মৃত্যু হয়।