অনলাইন ডেস্ক:
সাংবাদিকরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরছেন। সাংবাদিকতা সত্যিই একটি কঠিন কাজ। সে ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ সাংবাদিকতায় আসতে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ জোগাবে। সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।
বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা এ আশা ব্যক্ত করেছেন। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশসেরা ১১ জন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তৃণমূল সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ৬৪ জেলার ৬৪ জন প্রবীণ ও গুণী সাংবাদিককে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে নবীন-প্রবীণ সাংবাদিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ফেরদৌস ও চিত্রনায়িকা বুবলী।
এই আয়োজন ঘিরে গতকাল বিকেল থেকে জমে ওঠে আইসিসিবি। দেশের ৬৪ জেলা থেকে আসা গুণী ও প্রবীণ সাংবাদিকদের ঘিরে অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হয়। পুরো অনুষ্ঠানস্থল হয়ে ওঠে প্রবীণ ও নবীন সাংবাদিকের মিলনমেলায়। ছিলেন বিনোদন অঙ্গনের একঝাঁক তারকা।
দেশের গণমাধ্যমে গত বছর প্রকাশিত ও প্রচারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিচার-বিশ্লেষণ করে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ১১ জনকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে স্বাধীন জুরিবোর্ড। অধ্যাপক গোলাম রহমানের নেতৃত্বে জুরিবোর্ডে ছিলেন সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, টিভি টুডের প্রধান সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুল, দৈনিক দেশ রূপান্তরের সম্পাদক অমিত হাবিব, আলোকচিত্রী ও লেখক নাসির আলী মামুন, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাওন্তী হায়দার ও সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক।
তাঁদের বিবেচনায় সেরা ১১ হলেন : মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে দ্য ডেইলি স্টারের রিপোর্টার আহমাদ ইশতিয়াক (প্রিন্ট), মাছরাঙা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি কাওসার সোহেলী (টেলিভিশন), জাগোনিউজ২৪.কমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম (অনলাইন)। অপরাধ ও দুর্নীতি ক্যাটাগরিতে দেশ রূপান্তরের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি শোয়েব চৌধুরী (প্রিন্ট), জিটিভির স্টাফ রিপোর্টার জান্নাতুল ফেরদৌসী (টেলিভিশন), নিউজ বাংলা২৪.কমের ফ্রিল্যান্সার জেসমিন পাপড়ি (অনলাইন)। নারী ও শিশু ক্যাটাগরিতে সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজীব আহাম্মদ (প্রিন্ট), আনন্দ টিভির রিপোর্টার শওকত সাগর (টেলিভিশন) ও ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আদনান রহমান (অনলাইন)। অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রে মাছরাঙা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মাজাহারুল ইসলাম (টেলিভিশন) এবং আলোকচিত্রে প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক দীপু মালাকার। গতকাল তাঁদের ১০ জনের হাতে পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে আড়াই লাখ টাকা, সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র দেওয়া হয়। একজন অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
জেলা থেকে একজন করে মোট ৬৪ জন প্রবীণ ও গুণী সাংবাদিকের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা, সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র দেওয়া হয়। পরিয়ে দেওয়া হয় উত্তরীয়। তাঁদের মধ্যে ২৫ জনই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁদের অনেকের। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এ ধরনের সম্মানে ভূষিত হওয়ায় তাঁরা গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২১ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সায়েম সোবহান আনভীর। অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান অতিথিরা। প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ বলেন, সমাজের সব অনিয়ম দায়িত্বশীলদের নজরে আনার কাজটি করে যান সাংবাদিকরা। তাঁরা সমাজকে সঠিক পথে প্রবাহিত করতে যে ভূমিকা পালন করেন, তা অন্য কারো দ্বারা সম্ভব নয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করায় বসুন্ধরা গ্রুপকে ধন্যবাদ জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ সব সাংবাদিকের মধ্যে উৎসাহ জোগাবে। সাংবাদিকতায় উৎসাহ জোগাবে। একই সঙ্গে তৃণমূলের গুণী সাংবাদিকদের সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে একটা মহৎ কাজ করা হলো। এ জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে সাধুবাদ জানাই। ’ তথ্যমন্ত্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের অভিনন্দন জানান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে পাবনার সাংবাদিক রণেশ মৈত্রের বক্তব্যের সূত্র ধরে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার চালানোয় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি কোন আইনের মাধ্যমে বিচার প্রত্যাশা করবেন? তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই আইন করা হয়। এই আইনের ফলে অনেকেই বিচার ও নিরাপত্তা পেয়েছেন। তবে এই আইনের কারণে কোনো সাংবাদিক বা নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে সর্বোচ্চ দৃষ্টি রাখতে প্রশাসনকে বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘সারা দেশ থেকে প্রবীণ ও গুণী সাংবাদিকদের সম্মানিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করার এই পদক্ষেপ দেশের নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের অনুপ্রাণিত করবে। এই আয়োজনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। ’ আগামী বছর থেকে পুরস্কারের পরিধি আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী বছর ২৫ জন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। আর তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়া হবে ১০ লাখ টাকা করে। প্রতিবছরই এই আয়োজন করবে বসুন্ধরা গ্রুপ।
আহমেদ আকবর সোবহান আরো বলেন, ‘কালের কণ্ঠ পত্রিকার মধ্য দিয়ে আমরা মিডিয়াজগতে পা রাখি। তারপর একে একে সাতটি মিডিয়া হাউস করেছি। বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের এক নম্বর পত্রিকা। সবার হাতে হাতে পত্রিকাটি দেখা যায়। ’ তিনি বলেন, ‘আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করছি, যিনি না হলে আজকে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারতাম না। ’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সত্যকে সত্য বলবেন, মিথ্যাকে মিথ্যা। আমাদের পত্রিকা প্রকাশনার উদ্দেশ্যই ছিল সত্য তুলে ধরা। ’ তিনি দেশের অগ্রযাত্রায় ব্যবসায়ীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করার আগে অবশ্যই তাঁদের অবদান, তাঁদের কষ্টের কথা স্বীকার করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো অন্যায় বা জুলুমের শিকার না হন, সেদিকে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছি। আমাদের নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়। ’
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একটি কঠিন কাজ। এই পেশাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। তাতে সারা দেশ থেকে সাংবাদিকদের সহায়তা পাচ্ছি। ’ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা জনগণের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরছেন অনেক ঝুঁকি নিয়ে। আজকের এই পুরস্কার সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ’
জুরিবোর্ডের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘যাঁরা সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন, যাঁরা সংবাদ জনগণের কাছে বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন, যাঁরা নিজেদের অবস্থানকে সৎ রেখেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ’
তৃণমূলের গুণী সাংবাদিকদের মধ্যে আট বিভাগ থেকে আটজন মঞ্চে এসে সম্মাননা গ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন : রাজশাহী বিভাগ থেকে পাবনার রণেশ মৈত্র, খুলনা বিভাগ থেকে যশোরের অধ্যাপক মসিউল আযম, ঢাকা বিভাগে নরসিংদীর নিবারণ চন্দ্র রায়, চট্টগ্রাম বিভাগে রাঙামাটির এ কে এম মকছুদ আহমেদ, সিলেট বিভাগে সিলেটের আব্দুল মালিক চৌধুরী, বরিশাল বিভাগে বরিশালের মানবেন্দ্র বটব্যাল, রংপুর বিভাগে গাইবান্ধার গোবিন্দলাল দাস এবং ময়মনসিংহ বিভাগে জামালপুরের এ এ কে মাহমুদুল হাসান দারা। তাঁদেরসহ সব গুণী সাংবাদিককে ক্রেস্ট ও সম্মাননা প্রদান এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।
গুণী সাংবাদিকদের মধ্য থেকে বক্তব্য দেন পাবনার রণেশ মৈত্র। তিনি বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। তাঁরা কী করে আমাকে খুঁজে পেয়েছেন আমি জানি না। আমি অভিভূত। শেষ বয়সে এসে এমন একটি সম্মানে ভূষিত হওয়ায় বসুন্ধরা গ্রুপকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ’
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন