গত ৪ মার্চ থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীতে অভিযান শুরু করেছে। রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থাপনা তৈরি করায় তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশে ছাদে থাকা একটি রেস্তোরাঁও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে অনেককেই আটক করে বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এই লেখা তৈরি করা পর্যন্ত রাজধানীতে দুটি ভবনে অভিযান চালায় রাজউক ও সিটি করপোরেশন।
ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাভাবে এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। কিন্তু কিভাবে এবং কোন শক্তির মাধ্যমে তাঁরা এসব অন্যায় কার্যক্রম সহজেই করে যাচ্ছেন, সেটি যথাযথ তদারকির আওতায় আনার অনিবার্যতা তৈরি হয়েছে।
যেকোনো ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত, ঠিক তেমনিভাবে কোন ভবনে কী ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকবে, সে বিষয়েও একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। এর আগে আমরা লক্ষ করেছি, অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। সেসব প্রতিবেদনের বেশির ভাগেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, শর্ট সার্কিট, ইলেকট্রিক চুলা, গ্যাস ও মাটির চুলা, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা প্রভৃতি অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের কারণ।
এ ছাড়া ঢাকা শহরে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অপরিকল্পিত ভবনের কারণেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ এবং অপরিকল্পিত ভবনের সমাপ্তি কেন টানা সম্ভব হচ্ছে না? ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ভবনগুলো যারা ব্যবহার করছে এবং অপরিকল্পিত ভবন তৈরিতে যারা জড়িত রয়েছে, তারা এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। আমি মনে করি, এসব ক্ষেত্রে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কোনো শক্তির কাছেই সরকারের মাথা নত করা উচিত নয়।
বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান স্লোগান হলো দেশের উন্নয়ন। নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই উন্নয়ন সার্থকতা পায়। কিন্তু যেখানে মানুষের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই বা সংকট আছে, সেখানে উন্নয়নের বিষয়টি আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সব ধরনের কলকারখানা সরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। প্রশাসন যেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সেখানে কারখানা ও শ্রমঘন শিল্প স্থানান্তর করবে কিভাবে?
আগের অন্যান্য অগ্নিদুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল শিল্প জোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া, নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলাসহ ভবন নির্মাণ এবং মার্কেট ব্যবস্থাপনা। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ারি এবং সচেতন করতে বক্তব্য ও নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সেসব নির্দেশনার প্রায় কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, মেয়রের অঙ্গীকার এবং প্রশাসনের তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও কেন রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার আশঙ্কা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা কঠিন হলেও অসম্ভব না।
আমরা সর্বস্তরের মানুষ যদি সচেতন হই, তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যেকোনোভাবেই আমাদের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া অতীব জরুরি। সর্বোপরি আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকেও সচেতন করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়