অনলাইন ডেস্ক:
পাকিস্তান আমলে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এইচ টি ইমাম। যবনিকা টানলেন বাংলাদেশ সরকার ও রাজনীতির মাঠের প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তাঁর দীর্ঘ এই কর্মজীবন ছিল উত্থান-পতন ও নানা রোমাঞ্চে ভরা। তিনি পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদসচিব হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকরা তাঁকে জেলে পুরেছে। সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। চাকরিতে ফিরেছেন। সচিব হয়েছেন। আবারও পদ হারিয়েছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। অনেক সময় মূল্যায়ন না পাওয়ায় মনঃকষ্টে ভুগেছেন, কিন্তু বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজেকে রাজনীতির মাঠে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সংকট মোকাবেলায় ব্যাপক দক্ষতা দেখিয়ে সরকারপ্রধানের কাছে ও দলে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন।
ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হন এইচ টি ইমাম। তিনি ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫২-৫৪ শিক্ষাবর্ষে পাবনা কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ১৯৫৪-৫৬ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি ১৯৫৬-৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর কমনরুম সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। হোসেন তৌফিক ইমাম, যিনি এ দেশে বেশির ভাগ মানুষের কাছে এইচ টি ইমাম নামে পরিচিত, তিনি বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এ দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার নানা ঐতিহাসিক ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে হারাল দেশ।
পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ প্রশাসনের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। নিজের মেধা, দক্ষতা দিয়ে ঊর্ধ্বতনদের প্রিয়ভাজন হন।
একজন সরকারি কর্মকর্তা এইচ টি ইমাম কিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তার বর্ণনা আছে ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইয়ে। বইটির মুখবন্ধে এইচ টি ইমাম লিখেছেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অবাঙালি পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে আমরা সরকারের উচ্চপদ দখল করতে সক্ষম হই। চাকুরিজীবনের প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সচেষ্ট ছিলাম। তিনি বাঙালি জাতির জন্য যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা ছিল একজন পিতারই ভূমিকা। মায়া, মমতা, কল্যাণ ও মঙ্গল করাই পিতার কাজ। বঙ্গবন্ধুও তাই করেছিলেন। তার ভালোবাসা ও স্নেহ ছিল অকৃত্রিম ও দরদমাখা।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকেই একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাঙামাটির ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) ছিলেন এইচ টি ইমাম। সেখানে তিনি আরো কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে তিনি রামগড়ে এবং পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইচ টি ইমাম দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদসচিবের দায়িত্ব পান। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।
এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে তাঁর সমালোচনাকারীদের দুটি বড় অভিযোগ হলো, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি খোন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন এবং এর আগে বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদসচিবের দায়িত্বে থাকা এইচ টি ইমাম পদের কারণেই ওই শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন বলে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে জানিয়েছেন। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অবৈধ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের সঙ্গে এইচ টি ইমামের সম্পর্ক যে ভালো ছিল না তার প্রমাণ মেলে ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট তাঁর জেলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল খাটেন এইচ টি ইমাম। সে সময় সামরিক আদালতে দুটি মামলায় তাঁর বিচার হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি দুটি মামলায়ই খালাস পান। এইচ টি ইমামের বাকশালে যোগদানের বিষয়ে তাঁর মনোভাব জানা যায় তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইটিতে। বইটির ‘আমার কথা’ অংশে এ প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম তাঁর মনোভাব তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাকশালে যোগদান প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ‘বাকশালে আমি তো নিজে থেকে যোগ দেইনি। আমার সম্মতি ছাড়াই বাকশালের চেয়ারম্যানের সচিব নিযুক্ত করা হয়েছিল। একজন আমলার পক্ষে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়া অস্বস্তিকর ছিল। তাহলে এ জন্য আমাকে কেন বাকশালী বলা হবে?’ (‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’, পৃষ্ঠা ২৩)।
বইটির ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় এইচ টি ইমাম লিখেছেন, ‘আমার কথা অত্যন্ত ধৈর্য্যের সঙ্গে সেদিন শুনেছিলেন এরশাদ সাহেব। পরে আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু বিরাট নেতা ছিলেন। বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য আপনার এত ঝামেলা যাচ্ছে। আমি দেখব।’
রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে আবারও কাজ করার সুযোগ পান এইচ টি ইমাম। এরশাদের আমলে ১৯৮৪ সালে তিনি যোগাযোগসচিবের দায়িত্ব পান; যদিও পরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝিতে ২৭ বছরের বেশি সরকারি চাকরি জীবনের ইতি টানতে অবসরের আবেদন করেন এইচ টি ইমাম। ১৯৮৮ সালে তিনি অবসরে যান।
অবসরে গিয়ে প্রথম দিকে ব্যবসা করবেন বলে মনস্থির করেন এইচ টি ইমাম। এই লক্ষ্যে তিনি স্ত্রী ইসমাৎ ইমামকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। বেশ কিছু ব্যবসার চেষ্টা করেও পরে বুঝতে পারেন তিনি এ কাজের জন্য সঠিক মানুষ নন। পরে তিনি ব্যবসায় ইতি টানেন।
রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম তাঁর ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘১৯৮৯-৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় হলাম বন্ধুবর মোনায়েম সরকারের অনুরোধে। গ্রামেও ঘুরলাম অনেক। ১৯৯৩-৯৪ সালে ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশ কাজ করে দিলাম হানিফের পক্ষে। ১৯৯৬ সালে আবার অনুরোধ। ওই সময় বেশ কাজ করেছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী আসাফউদ্দৌলা পরিশ্রম করলাম। সময়ও দিলাম অনেকটা। নির্বাচনের পরে আমাকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলো।’
একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এইচ টি ইমাম এ দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। রাজনৈতিক মহলে ধারণা করা হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে এইচ টি ইমামের নানা কৌশল অনেক বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। এ কারণেই তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরো বেশি আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এইচ টি ইমাম আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
প্রাচীন একটি দল আওয়ামী লীগে একজন সরকারি কর্মকর্তার এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, ‘আমাদের হয়তো আনুগত্য বা বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি ছিল। সে জন্যই হয়তো এত পুরনো একটি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হয়েছেন একজন আমলা।’
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এইচ টি ইমাম। এই কমিটির সদস্যসচিব ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ বলেন, ‘তিনি একজন অভিজ্ঞ মানুষ ছিলেন। সব বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দিতেন। সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন। আমাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কাজে প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন। পোলিং এজেন্টদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো দলের জন্য অনেক সহায়ক হয়েছে। আওয়ামী লীগ তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণ করবে।’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় আমি তাঁর সঙ্গে থেকে কাজ করেছি। উনি মূলত একজন ডাকসাইটে আমলা হলেও রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ ছিলেন। তিনি বিচক্ষণ ও মেধাবী একজন ব্যক্তিত্ব। আমাদের নির্বাচন পরিচালনার সময়ে তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতেন। নির্বাচনকালীন সংকটে তাঁর মতো দায়িত্ব নিয়ে গুছিয়ে কাজ করার মানুষ আমাদের সংগঠনে কমই আছে।’