অনলাইন ডেস্কঃ
পাঁচ সংসদীয় আসনের আসন্ন উপনির্বাচনে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলই আওয়ামী লীগের বড় ভয়। মাঠের প্রতিপক্ষ বিএনপি প্রার্থীকে মোকাবিলা করার চেয়ে দলীয় কোন্দল নিরসনকেই বড় করে দেখছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। আর কোন্দল নিরসন করে সব পক্ষকে মাঠে নামানো গেলে নৌকার প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত বলে মনে করেন তারা। এ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন পরিচালনার প্রধান হবেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সমন্বয় করবেন সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। পাবনা-৪ আসনে প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান এবং নওগাঁ-৬ আসনে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। উভয় নির্বাচন সমন্বয় করবেন সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘উপনির্বাচনে বিএনপি কোমর বেঁধে মাঠে নামবে। আমরাও আটঘাট বেঁধে মাঠে নামব। এজন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এক আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলে মান-অভিমান থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই এক কাতারে নৌকাকে জেতাতে মাঠে নামবে। আমি বিশ্বাস করি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করা সম্ভব হলে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।’
জানা গেছে, ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনে ৫৬ জন দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন এখনো তফসিল ঘোষণা করেনি বলে আওয়ামী লীগও প্রার্থীর নাম প্রকাশ করেনি। তবে এ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবীব হাসানকে প্রার্থী করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। হাবীব হাসানের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা। তারা হাবীব হাসানের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে যুব মহিলা লীগের নাজমা আক্তারকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি করেছিলেন। এ সময় নানা স্লোগানও দেন যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা। যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার তখন উপস্থিত ছিলেন। এখানে ৫৬ জন মনোনয়ন প্রত্যাশীকে একযোগে মাঠে নামানো হবে হাবীব হাসানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জানতে চাইলে হাবীব হাসান বলেন, ‘যারা রাজনীতি করেন তাদের প্রত্যেকের আশা থাকতে পারে। সে কারণে বেশি সংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী হতেই পারে। তবে দল যাকে প্রার্থী করবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পক্ষেই কাজ করবে।’ তিনি বলেন, মনোনয়ন নিয়ে মান-অভিমান থাকতেই পারে। আওয়ামী লীগের সুবিধা হচ্ছে, ক্রাইসিসের সময় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা এক হয়ে যান। এটা উপনির্বাচন হলেও আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ বিএনপি আদাজল খেয়ে মাঠে নামবে। আশা করি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’
ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ২০ জন। এ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে যাত্রাবাড়ী থাানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনুকে। উপরে উপরে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কাজী মনিরুল ইসলামের সঙ্গে আছে জানালেও শেষ পর্যন্ত ভালোভাবে মাঠে কাজ করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় শুরু হয়েছে। ঢাকার প্রবেশদ্বার খ্যাত ঢাকা-৫ আসনটি যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কদমতলী থানার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত। যাত্রাবাড়ী ও ডেমরার শীর্ষ নেতাদের মনিরুল হক মনুর পক্ষে মাঠে নামানো কঠিন হয়ে পড়বে। এ আসনে মোল্লা পরিবারের সঙ্গে পূর্ব থেকেই মনু গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল। মনোনয়নকে ঘিরে এ কোন্দল আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাইনবোর্ড এলাকার বাঁশপট্টি দেখভাল করতেন মোল্লা পরিবারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মো. শাহ আলম। মনু মনোনয়ন পাওয়ার পর পরই গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দখল নিয়েছেন মনু গ্রুপ হিসেবে পরিচিত আবদুল আলীম, সেলিম বাবু, মনির হোসেন খোকন। সারুলিয়া বাজার ও দলীয় কার্যালয়ে নিয়মিত মেইনটেইন করতেন আজমত আলী। এখানেই দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা হয়ে আসছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আজিজ প্রধানরা দখল নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আজিজ প্রধান বলেন, ‘আমাদের ৬৮ নম্বর কাউন্সিলের কাছে আজমত আলী চাবি হস্তান্তর করেছেন। দলীয় কার্যালয়ের চাবি এতদিন পর কেন হস্তান্তর করতে হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজমত প্রধান একটি বিশেষ পরিবারের লোক। কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মনোনয়ন পেয়েছেন। এখন আমরা এখানে বসে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করব।’
বাঁশেরপুল এলাকায় দলীয় কার্যালয়ের ক্লাবটি পরিচালনা করতেন শাহ আলম। এখন আলীম ও মনির হোসেন খোকন, বাবু বক্স দখলে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মনির হোসেন খোকন বলেন, ‘আমাদের নামে অপপ্রচার করা হচ্ছে। দলের কার্যালয় দখল নেওয়ার কী আছে? কাজী মনিরুল হক মনু ভাই মনোনয়ন পেয়েছেন। তার অনুসারীরা সেখানে গিয়ে বসেছিলেন। আগে যারা বসতেন তারা সেদিন আসেনি। আমরা মিছিল করে চলে এসেছি।’ সব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে এক কাতারে নামিয়ে জয়লাভ করতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু বলেন, ২০ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে ১৭ জনের কোনো পদ-পদবি নেই। আমি ও আমার সেক্রেটারি হারুনুর রশিদ মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক লীগের দক্ষিণের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন আমার সঙ্গে আছে। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার বাড়িতে গিয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলাম। মোল্লার বড় ছেলে সজল কিংবা মোল্লার স্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। এমপি হওয়ার আগেই দলীয় কার্যালয় দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কাউকে কোনো কার্যালয় দখল নিতে নির্দেশ দিইনি। কারা কী করছে আমি কিছু জানি না।
এদিকে দলীয় প্রার্থীর দেখা না পাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মশিউর রহমান সজল বলেন, ‘তারা কোনো ধরনের খবর না দিয়েই আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার মা সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হয়েছেন। আমি ৮টার দিকে। দলীয় প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু ও যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ আমার বাড়িতে এসেছিল বলে শুনেছি। কিন্তু কেউ আমাকে ফোন দেয়নি। কল লিস্ট চেক করলেই প্রমাণ পাবেন।’ দলের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে থাকবেন কিনা জানতে চাইলে সজল বলেন, ‘আমার অভিভাবক শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছি। প্রার্থী না ডাকলেও আমি নৌকার পক্ষে কাজ করব।’
পাবনা-৪ আসনের সাবেক এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ২৭ জন। এর মধ্যে ডিলুর পরিবার থেকে মনোনয়ন ফরম তুলেছিলেন ৬ জন। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, এই আসনে ত্রিমুখী সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা মেটানো প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নুরুজ্জামান বিশ্বাসের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। স্থানীয়রা বলছেন, সাবেক এমপির জামাতা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু কোনোভাবেই তার ক্ষমতা খর্ব হোক সেটা চাইবেন না। সে কারণে প্রকাশ্যে দলের বিরোধিতা না করলেও মন থেকে চাইবেন না নুরুজ্জামান বিশ্বাস এমপি হোক। কারণ বিশ্বাস এমপি হলে আসন্ন পৌর নির্বাচনে তার জন্য হুমকি হতে পারে। বিগত উপজেলা নির্বাচনে নুরুজ্জামান বিশ্বাস ছিলেন দলের মনোনীত প্রার্থী। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেচুর রহমান মিন্টু। এই মিন্টু ডিলু পরিবারের লোক হিসেবে পরিচিত। গত উপজেলা নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ তিনি নিতে পারেন এবারের উপনির্বাচনে-এমনটাই বলছেন স্থানীয়রা। আর বিএনপির হাবিবুর রহমান হাবিব এমপি হলে মিন্টুদের রাজত্ব ঠিক থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। একাধিক সূত্র জানায়, ডিলু পরিবারের লোকজনকে মাঠে নামানো কঠিন হবে। কারণ এই আসনটি ডিলু পরিবারের জন্য বার বার নৌকা বিজয়ী হয়েছেন সেটা প্রমাণ করতে চায় তারা। উপনির্বাচনে হেরে গেলে আগামী নির্বাচনে ডিলু পরিবার থেকে মনোনয়ন পাওয়ার সমীকরণ থাকবে। সে কারণে এখানে সবাইকে এক করাই কঠিন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতারা।
তবে সবাই নৌকার পক্ষে কাজ করছে জানিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, প্রয়াত এমপি সাহেবের স্ত্রী অসুস্থ। তাই তিনি ঢাকায় আছেন। বাকি সব প্রার্থী আমার পক্ষে কাজ করছেন এবং শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন।
নওগাঁ-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন রানীনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হেলাল। এই আসনে মোট ৩৪ জন দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। শক্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন প্রয়াত এমপি ইস্রাফিল আলমের স্ত্রী সুলতানা পারভীন বিউটি। এই আসনটি আত্রাই ও রানীনগর দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। অধিকাংশ নেতা-কর্মীই হেলালকে সমর্থন দিয়েছেন। তারপরও অনেকে তার বিরোধিতা করছেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক সুমন ও তার অনুসারীরা আত্রাইয়ে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিও করা হয়। তবে ব্যক্তিক্রম হচ্ছে সিরাজগঞ্জ-১ আসন। এই আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ নাসিমের বড় ছেলে প্রকৌশলী তানভির শাকিল জয়। জয়ের পক্ষেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সবাই ঐক্যবদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আমি ৫ দিনের সফরে পাবনা, নওগাঁয় অবস্থান করব। আমার বিভাগের তিনটি উপনির্বাচন হবে। কোনোটাতেই সমস্যা হবে না। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা মাঠে ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকাকে বিজয়ী করতে কাজ করবে।