যশোর প্রতিনিধি : গত কয়েক বছরে বদলে গেছে যশোর শহর। সরকারি নানা প্রকল্পে এখন নির্মাণাধীন বড় বড় রাস্তা। হয়েছে আইটি পার্ক, মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শহর লাগোয়া এক ‘প্রান্তিক পল্লী’তে উন্নয়নের তেমন প্রভাব পড়েনি। আজও “বুনো পাড়া” নামে পরিচিত এই পল্লী । এখানকার অধিবাসীদের জীবনমান এখনো তলানিতে।‘আমরা তো গরীব মানুষ। সরকার, চেয়ারম্যান আমাগো কথা ভাবে না। তোমাগে কোয়ে কি অবে। ঠিক মতো ভাতই জোটে না। ছাওয়াল, মাইয়েরা ইসকুলি যাবে কী কইরে?’সরেজমিন যশোর সদর উপজেলার ধর্মতলার বুনোপাড়া নামে খ্যাত কর্মকারপাড়ায় গেলে বেশ আক্ষেপ করে এমন কথা শুনিয়ে দিলেন পঁয়তাল্লিশোর্ধ দিনমজুর সৌরভ কর্মকার।তার শীর্ণ টিনের ঘরের অপ্রশস্ত বারান্দায় বসে অভিযোগের প্রমাণও মিললো। পল্লীটিতে ৩২টি পরিবারের দুই শতাধিক মানুষের বাস। যাদের আবার একটি বড় অংশ শিশু। কিন্তু শিশুদের অধিকাংশ শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া। তাদেরই একদল ছোটাছুটি করছে সামনের ফাঁকা জায়গায়।পাঁচ সন্তানের জননী বেবি কর্মকার জানালেন, তার স্বামী পূর্ণ চন্দ্র কর্মকার রিকসা চালান। তবে বয়স হয়ে গেছে, তাই বেশি আয় করতে পারেন না। ছেলেরা দিন মজুরের কাজ করেন। তবে প্রতিদিন কাজ মেলে না। সংসারে তার রাক্ষুসে অভাব। এ কারণে ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া শেখাতে পারেননি।পল্লীটির মাতব্বর বিষ্ণু কর্মকার জানান, কয়েক পুরুষ ধরে তারা এখানে বসবাস করছেন। যাদের প্রায় সবাই পেশায় দিনমজুর। রেলওয়ের ৪৪ শতক জমির উপর তারা আছেন। কিন্তু সম্প্রতি সেই জমির বেশ কিছু অংশ প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। অর্থাভাবে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। এখনো পর্যন্ত কোন শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করেনি। তার আগেই ঝরে গেছে। সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত তারা। তবে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা কেউ কেউ অবশ্য সন্তানদের নিয়ে স্বপ্নও দেখছেন। তাদেরই একজন গৃহবধূ মনিমালা কর্মকার বললেন, ‘আমার স্বামী মোটরগ্যারেজে কাজ করেন। তার একমাত্র আয়ে চলে চার সন্তান, মা-বাবাসহ আট সদস্যের সংসার। তারপরও দুইজনকে স্কুলে পাঠিয়েছি। যত কষ্ট হোক তাদের লেখাপড়া শেখাবোই।’সীমান্ত কর্মকার নামে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানালো, তিন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে তারা স্কুলে যায়। সবাই স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু একটু বড় হলে আর যায় না।ঠিক উঠান নয়, ‘গলিপথ’ ধরে কর্মকার পল্লীটি ঘুরে দেখা গেলো, কোন ঘরই পাকা নয়। নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। হাঁটতে হাঁটতে সৌরভ কর্মকার জানালেন, বর্ষা মৌসুমে ঘরের মধ্যে পানি জমে যায়। দুর্গন্ধময় সেই পানির মধ্যে বসবাস করার কারণে অনেকে চর্মরোগে আক্রান্ত হয়।ঘুরতে ঘুরতে পাওয়া গেলো ৯০ ছুঁই ছুঁই সারথী কর্মকারকে। কেমন আছেন জানতেই ফুকলা দাঁতে এক গাল হেসে বললেন, ‘যুদ্ধ দেহিছি। একনো মরিনি।’ স্থানীয়রা জানালেন, ৯০ বছর বয়সে এসে তিনি বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন।যোগাযোগ করা হলে যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন উৎসবের সময় সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। তাদের দাবি অনুযায়ী একটি ডিপটিউবয়েলও দিয়েছি। কয়েকজনকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করছি।’