অনলাইন ডেস্ক:
২৫ মার্চ, ১৯৭১। অহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিন। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সর্বত্র। পাকিস্তানের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আলোচনার ফল জানার জন্য দেশবাসী উদ্বিগ্নচিত্তে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এদিন দুই শীর্ষ নেতা কিংবা তাঁদের উপদেষ্টাদের মধ্যে কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বাঙালি নেতৃত্বকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা লে. জে. পীরজাদা সকালে ধারণা দিলেন, হস্তান্তরের দলিল চূড়ান্ত। শেখ মুজিব-ইয়াহিয়ার স্বাক্ষরের পর তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হবে। কিন্তু আলোচনার ফল সম্পর্কে কিছুই জানানো হলো না। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু পার্টিগুলোর নেতা ওয়ালী খান, বেজেনেজা এবং মিয়া মোমতাজ দৌলতানার ঢাকা ত্যাগ করেন।
মানুষ যখন অপেক্ষার প্রহর গুনছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া লোকচক্ষুর আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। পাক বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে করাচির পথে। প্রেসিডেন্টের বিমান ঢাকা-কলম্বো হয়ে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে রাত ১১টায়। এই অবতরণের খবর বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালকের মাধ্যমে ঢাকায় বেতারবার্তায় পাঠানো হলো। ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স থেকে রাত সাড়ে ১২টায় ফরমান পাঠানো হলো—SORT TYEMCUT। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ট্যাংক ও ট্রাকসহ ইসলাম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার অভিযানে নেমে পড়ল। শুরু হলো বাঙালি নিধন। শুরু হলো ইতিহাসের গণহত্যা। নির্বাচিত হওয়ার পরও বাঙালির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলো। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো যুদ্ধ, যে যুদ্ধে পরাক্রমশালী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানিদের হারিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জয়ী হয়েছে বাঙালি জাতি।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সারা দিন ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দুপুরের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু কর্মীদের যার যার এলাকায় চলে যেতে বলেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সারা দিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসে শলাপরামর্শ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ‘২৪ মার্চ বিকেল থেকেই বঙ্গবন্ধু সকলকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পেছনের ঘরে প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে এক মিনিট করে কথা বলেন। অনেক ভিড়ের মধ্যে বাথরুমেও কারো কারো সাথে কথা বলেন। ২৫ মার্চ তারিখেও এ ধরনের শলাপরামর্শ চলে। বঙ্গবন্ধু একে একে সকলকে বিদায় দিচ্ছেন। বিকেল থেকেই যেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে।’ রাত ৯টার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।’ রাত ১টায় সেনাবাহিনীর একদল সদস্য বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে প্রথমে শেরেবাংলানগরে সদর দপ্তরে, পরে সেনানিবাসে নিয়ে যান। গ্রেপ্তারের আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও ঢাকার চিত্র পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্মৃতিচারণা থেকে। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, ‘আনুমানিক রাত ১২টা সাড়ে ১২টার পর, স্পষ্ট মনে আছে, এ সময় আমি বাঘের মতোই ক্ষুব্ধ গর্জন শুনেছিলাম। এমনভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল, সমস্ত বাড়িটা বোধ হয় ধসে পড়বে। ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ওপরে উঠে এলো। বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সামনে। পরে শুনেছি সৈন্যরা সে সময় তাঁকে হত্যা করে ফেলত, যদি না কর্নেল হাত দিয়ে আড়াল করত।’
পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ণ সামরিক অস্ত্র নিয়ে রাত ১১টার পর দেশজুড়ে শুরু করে এই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। বাঙালিকে দমানোর নামে গণহত্যার যে অভিযান শুরু হয়েছিল, তার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। অপারেশনের টার্গেট নির্ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর (পরে বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশলাইন দখল; টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বেতার-টেলিভিশন, প্রেসিডেন্ট হাউস, গভর্নর হাউসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিরোধকারীদের শায়েস্তা করা।
নগরীতে কারফিউ জারি করা হয়। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। উন্নত মানের আধুনিক সমরাস্ত্র এম ২৪ ট্যাংক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে দানবমূর্তিতে বেরিয়ে পড়ল নিধনযজ্ঞের নায়করা। হকচকিত নিরস্ত্র মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
পিলখানার আড়াই হাজার বাঙালি জোয়ান, রাজারবাগের প্রায় এক হাজার বাঙালি পুলিশ আত্মসমর্পণ না করে প্রতিরোধে অবতীর্ণ হন। আধুনিক অস্ত্রের হামলার মুখে টিকতে না পেরে জীবনপণ লড়াইয়ে অনেকেই শহীদ হন। অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অনেকে বন্দি হন। আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচার গণহত্যার শিকার হন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। জগন্নাথ হলের ৭০ জনকে মেরে খেলার মাঠে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ছাত্রীদের রোকেয়া হলের ৪৫ জন হানাদারদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় রমনা কালীমন্দির। পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলে পড়ে ঘাতকদল। দোকানপাট, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কেবল শাঁখারীবাজারেই মারা পড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রায় ৬০০ জন।
পাকবাহিনী আগুন লাগিয়ে দেয় দৈনিক ইত্তেফাক, দি পিপলস, গণবাংলা ও সংবাদ অফিসে। আত্মভোলা কবি শহীদ সাবের সংবাদ অফিসেই জীবন্ত ভস্মীভূত হন। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাঙালির গৌরব আর অহংকারের প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ও লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে পাকবাহিনী স্ত্রী-সন্তানের সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করে।
মেশিনগানের গুলি, ট্যাংক-মর্টারের গোলার আগুনের লেলিহান শিখায় রাত ২টার মধ্যে তারুণ্যের প্রাণস্পন্দনে উত্তাল থাকা নগরী ঢাকা ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। সে রাতে কত মানুষ শহীদ হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস একাত্তরের ২৮ মার্চ এক প্রতিবেদনে জানায়, সেই রাতে নিহত হয়েছে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১ এপ্রিলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। আর অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকা জানিয়েছিল, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা।
২৫শে মার্চ ইতিহাসে গণহত্যার কালরাত হিসেবে চিহ্নিত। ২০১৭ সাল থেকে দিনটি দেশে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।