দ্বিন বা ধর্ম সম্পর্কে আধুনিক দার্শনিক ও মনীষীরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেসব ব্যাখ্যার সঙ্গে মুসলিম মনীষীদের ব্যাখ্যার ভিন্নতা আছে। নিম্নে কয়েকজন মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদের ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করা হলো :
ইমাম রাগিব আল-ইসফাহানি (১১০৮ খ্রি.) ধর্মের সংজ্ঞা দিয়ে লিখেছেন, আরবি ভাষায় ধর্ম শব্দের প্রতিরূপ হলো দ্বিন ও ইসলাম। [রাগিব আল ইসফাহানি, আল-মুফরাদাত ফি গারিবিল কোরআন (কায়রো : দারুল হাদিস, ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ১৯৭]
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী প্রণিধানযোগ্য।
ড. মুহাম্মাদ জুহায়লির মতে, দ্বিন হলো আল্লাহ প্রবর্তিত একটি জীবন বিধান। এতে জ্ঞান ও অন্তরের কল্পনার কোনো স্থান নেই।
ড. আবদুল্লাহ দারাজ বলেন, দ্বিন হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের নাম। যে জীবনব্যবস্থায় আছে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় পালনকর্তা, বিধানদাতা ও নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের অধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং মনে প্রাণে গ্রহণ করা। এই অর্থেই আল-কোরআনে দ্বিন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
ড. দারাজ আরো লিখেছেন যে দ্বিন হলো একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা উচ্চ শক্তিধরের উদ্দেশ্যে মানুষ পালন করে থাকে। মানুষ সেই মহান শক্তিমান সত্তার অনুসরণ, আনুগত্য এবং তাঁর প্রেরিত নির্দিষ্ট নিয়মাবলি ও আইন-কানুন সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলে। আর মানুষ তার আনুগত্যের মাধ্যমে সম্মান, সফলতা ও উত্তম পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা করে। আর তাঁকে অমান্য ও নাফরমানি করার জন্য লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শাস্তির আশঙ্কা করে। [ড. আবদুল্লাহ দাররায, আদ-দ্বিন (কায়রো : দারুল কলম, ১৯৯৯), পৃ. ৪৬]
ধর্ম বিশ্বকোষে দ্বিনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে—দ্বিন হলো আল্লাহর স্বভাব ধর্ম, যা দিয়ে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ এই স্বভাব ধর্মের বেড়াজাল থেকে বহির্গমনে সক্ষম নয়। কেননা মানুষের ভালো লাগা ও প্রশান্তি লাভ করা একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত এই স্বভাব ধর্মকে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই নিহিত আছে। যুগে যুগে দেশ-কালভেদে কোনো মানবীয় সমাজ এই স্বভাব ধর্মের আওতাবহির্ভূত নয়। তাই এ ধর্মকে গ্রহণ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন এমন জ্ঞানশক্তি, যার দ্বারা সে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা করেন এবং তিনি এতদুদ্দেশ্যে অসংখ্য নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন।
মূল কথা হলো, দ্বিন বা ধর্ম হলো বিধাতার সৃষ্টি। যার ভিত্তি ওহি। এ জন্য মানব রচিত কোনো মত বা মানুষের ভয়ভীতি ও কল্পনা থেকে উৎসারিত কোনো বস্তু ধর্ম হতে পারে না। প্রথম মানুষ আদম (আ.)-কে যখন আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তখনই তিনি তাঁকে স্বভাব ধর্ম তথা ইসলাম দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাওরাত, যাবুর, ইনজিল ও কোরআন এ কথার সাক্ষী। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আমি বললাম, তোমরা সবাই এই স্থান থেকে নেমে যাও। পরে যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সৎপথের কোনো নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার সৎপথের নির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ৩৮)
উপরিউক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাত থেকে বহির্গমনের সময় ইসলাম ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন। তাই ইসলামই প্রথম ও শেষ ধর্ম। তবে ধর্ম শুধু বিশ্বাসের নাম নয়, বরং আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে জীবনযাপনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির নাম। এটি কেবলমাত্র ইসলামের মধ্যে পাওয়া যায়। ইসলামে আছে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সব দিকের সঠিক নির্দেশনা। তাই পৃথিবীর মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য ও আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান হলো ইসলাম।
(সূত্র : ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন, তুলনামূলক ধর্ম)