অনলাইন ডেস্ক:
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অর্ধেক আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসির এই সিদ্ধান্ত বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটকে আরো প্রকট করে তুলবে। এতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ বন্ধ হলে তার দায়ও কমিশনের ওপর পড়বে।
প্রশ্ন উঠেছে, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ ইভিএমের বিপক্ষে মত দিলেও কমিশন কেন তা আমলে নিল না।
এর জবাব গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যে পাওয়া গেছে। তিনি বলেছেন, ‘দলগুলো কে কী প্রস্তাব দিয়েছে তা আমাদের মুখ্য বিবেচনায় আসেনি। আমরা ভোটাররা যাতে ভালোভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ’ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা ঝুঁকির মুখে পড়ল কি না—এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, ‘ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব না। ’ গতকাল বুধবার নির্বাচন ভবনে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
কমিশনের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যে ২৮টি দল অংশ নিয়েছিল সেসব দলের বেশির ভাগ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশন সেই দলগুলোর মত বিবেচনায় না নিয়ে তাদের অসম্মান করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাকেও একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে নির্বাচন কমিশন সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিই। এখন কমিশনের সিদ্ধান্তে আমি নিজেও অসম্মানিত বোধ করছি। ’ তিনি বলেন, শুরু থেকেই এই নির্বাচন কমিশন আস্থার সংকটে ছিল। ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত সে সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
গতকাল নির্বাচন কমিশনে সিইসির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে নির্বাচনই না হয়।
সিইসি যা বললেন : গতকাল সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা ইভিএম নিয়ে চটজলদি কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। ইভিএম নিয়ে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে, যেসব অভিযোগ ছিল, সেসব পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেছিলাম আপনাদের টেকনিক্যাল পারসনদের নিয়ে আসেন। তাঁরা এসেছিলেন। একটা বক্তব্য চাউর রয়েছে যে ইভিএমে এখানে ভোট দিলে ওখানে চলে যাবে। এর কোনো প্রমাণ পাইনি এবং তারাও (রাজনৈতিক দলগুলো) দেখাতে পারেনি। ’
সিইসি বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি আস্থাশীল হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যালট পেপারে যে সমস্যা হয় তার সমাধান ইভিএমে ভালোভাবে পাওয়া যাবে। কেননা এতে সহিংসতা, কারচুপি সম্ভব হয় না। ’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘কোনো দলের চাওয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে আমরা নেই। আমরা সবার মতামত শুনেছি। সম্ভব হলে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করব। এখন সম্ভব হবে কি না জানি না। ’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ভোট করার দায়িত্ব ইসির। কিভাবে ভোট করলে স্বাচ্ছন্দ্যে করা যাবে, সুষ্ঠু হবে এবং ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন, সেটা আমাদের মুখ্য বিবেচনার বিষয়। ’
১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আরো বড় বিতর্ক তৈরি করবে কি না এবং ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করতে চাচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারে সামর্থ্যের একটা বিষয় আছে। আরেকটা বিষয় হলো, ১৫০টিতে ইভিএম, ১৫০টিতে ব্যালটে হলে ভোটের ফলাফলের তুলনা করা যাবে। আমরা ভবিষ্যতে আরো বেশি নিশ্চিত হতে পারব যে ইভিএম দিয়ে কী মন্দ হচ্ছে, না উত্তম হচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে তা জানতে আপনারা ওয়েট (অপেক্ষা) করেন, আমরাও ওয়েট করি। দেখি কী হয়! আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা জানিয়েছি। ’ তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সংকট ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও সংকট ছিল। এবার আদৌ নির্বাচন নিয়ে সংকট হবে কি না তা তো এখনই বলা যাবে না।
আওয়ামী লীগ চায়, জোটের শরিকদের বিভিন্ন মত : ইসির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন জোট ১৪ দলের একাধিক শরিক ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বলেছি, আধুনিক যে প্রযুক্তি, তা ব্যবহার করা সংগত। কারচুপির ও জালিয়াতির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। তার পরও কিছু কিছু করে ইভিএম চালু করা হয়েছিল। এবারও আমরা ৩০০ আসনে চেয়েছিলাম। ’
গতকাল সকালে আইভি রহমানের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বনানীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।
১৪ দলের শরিক জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ‘নতুন ও আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে আমরা ইভিএমকে সমর্থন করি। কিন্তু এর যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে সেগুলো সংশোধন করে ব্যবহার করতে হবে। জনগণের কাছে এ পদ্ধতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। ’
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর এক বিবৃতিতে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তকে ‘নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক’ বলে মত দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, বস্তুত এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন হুদা কমিশনের সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখল। এর জন্য ঘটা করে সংলাপের প্রয়োজন ছিল না।
১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত, কোথাও ইভিএমে ভোট হবে কোথাও হবে না, এটা আমরা সমর্থন করি না। ৩০০ আসনে একযোগে ইভিএমে ভোট নেওয়া গেলেই কেবল আমরা ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। ’
বিএনপির ‘না’ : ইসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে ইসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনগণ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। আমরাও মানছি না। এটাকে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। ’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশনও যে বর্তমান সরকারের একটা অঙ্গসংগঠন তা প্রমাণ হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে ইভিএম চেয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে ইসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কমিশনের ব্যাপারে বিএনপির একটুও আগ্রহ নেই। ’
সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় জাপা : ইসির সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার চায় জাতীয় পার্টি। গতকাল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘ইসির একতরফা এ সিদ্ধান্ত খুবই দুঃখজনক ও হতাশার। সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশন কারো কথার তোয়াক্কা করেনি। ‘ তিনি বলেন, ‘দেশে এখন নানা ধরনের সংকট চলছে। অর্থিক সংকট রয়েছে, ডলারের সংকট রয়েছে, ঠিক এই সময় উচ্চমূল্যের ভোটের মেশিন ক্রয় করার শৌখিনতার কী প্রয়োজন! আমরা দ্রুত ইসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহ্বান রাখছি। ’
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন