অনলাইন ডেস্কঃ
বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির আঁচ পড়েছে বাংলাদেশেও। সে কারণেই চলতি বছর যে সমারোহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার কথা ছিল, তা সম্ভব হয়নি। ঠিক তেমনই পালন করা যায়নি তাঁর হত্যাবার্ষিকীও। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল বিবিসির বিবেচনায় সর্বকালের সেরা বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ষড়যন্ত্রের হোতা ছিল পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। যত দিন যাচ্ছে নানা দিক থেকে ধানমন্ডির সেই হত্যাকান্ডের খবর নানা মহল থেকে বেরিয়ে পড়ছে।
১৫ আগস্ট দিনটি ভারতেরও স্বাধীনতা দিবস। উভয় দেশের পক্ষেই এ দিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার মনে আছে, ’৭৫ সালের জানুয়ারিতে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াই কে চ্যাবন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম তার সফর কভার করতে। তখন তিনি আর প্রধানমন্ত্রী নন, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি। তিনি যে নতুন দলটি গঠন করেছিলেন, তার নাম ছিল বাকশাল। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। তিনি এই নতুন দলের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবকে বেছে নিতে চেয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বিনীতভাবে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে স্নেহ করেন। কিন্তু আমাকে মাফ করবেন। আমি আর রাজনীতিতে নেই। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর দল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় তখন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। আর তার প্রধান পরামর্শদাতা পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তারা দীর্ঘ আলোচনা করেন। তারা বলেন, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বসবে ইসলামাবাদে। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। নিহত হয় বেশ কিছু প্রতিবাদী মানুষ। গোটা পৃথিবীতে তখন ওই খবর ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমার ভাইয়ের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি ইসলামাবাদের পার্লামেন্টে যোগ দিতে যাব না। তিনি কথা দিয়ে কথা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যাতে জয়ী হয় বাঙালিরা। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে ছিল না। পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন এজেন্টরা সে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়। ঘটে ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডের বাড়ি থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের রক্ত। সে রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে তাঁর এক বিশ্বাসঘাতক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর দেহটা নেড়ে দেখেন তিনি বেঁচে আছেন কিনা। যখন তিনি বুঝলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেঁচে নেই তখন জিয়াকে নির্দেশ দিলেন, এবার নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের আয়োজন কর। সামরিক বাহিনীর লোকেরা মুজিব মন্ত্রিসভার সদস্যদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে নিয়ে আসে শপথ গ্রহণের জন্য। ’৭৫-এর সেই ভয়াবহ ১৫ আগস্টে গোটা বিশ্ব তখন স্তব্ধ। বাংলাদেশ শোকসন্তপ্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ। ঢাকা রেডিও থেকে ওই মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করা হয়। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সংঘটিত ওই জঘন্যতম ঘটনার অন্যতম নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সরকারকে অভিনন্দন জানায় আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানরা। পাকিস্তান সেই রাতেই মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিল। ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে যখন সবাইকে এক এক করে মারা হয়, তখন বেঁচে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। খুনিরা তাকে খুঁজে পায়নি। বাড়ির বিদ্যুতের লাইন তারা কেটে দিয়েছিল। পরে রাসেলের গলার আওয়াজ পেয়ে তাকেও গুলি করে হত্যা করে জল্লাদরা।ওই খুনিদের অন্যতম জুনিয়র সামরিক অফিসার আবদুল মাজেদ বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন মাস পর নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী চার জাতীয় নেতাকে জেলে গুলি করে মারার পর মেজর ডালিমের সঙ্গে প্রথমে লিবিয়া ও পরে আমেরিকা হয়ে প্রায় ২০ বছর পাকিস্তানে কাটিয়ে কলকাতায় এসে আশ্রয় নেয়। করোনা শুরু হওয়ার দিন ১৫ আগে রাসেল হত্যাকারী মাজেদকে ভারতীয় গোয়েন্দারা কলকাতার ব্রডস্ট্রিট থেকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়। আগেই তার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। তাকে সাত দিনের মধ্যেই ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতের গোয়েন্দারা অভিযোগ তুলে বলেছে, শুধু মাজেদ নয়, বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যাকারীদের কয়েক হাজার লোক এখনো কলকাতার আশপাশে অবস্থান করছে। কংগ্রেস রাজত্বের আমল থেকে খুনি, সন্ত্রাসবাদী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী কী করে এই বাংলায় আশ্রয় পেল, কে তাদের আশ্রয় দিল, এই প্রশ্ন যখন উঠতে শুরু করেছে, তখনই করোনা এসে সব স্তব্ধ করে দিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনই গভীর রাতে ইন্দিরা গান্ধী খবর পান তার দুই কন্যা জার্মানিতে আছেন। তিনি তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিয়ে তাদের দিল্লিতে নিয়ে আসেন। প্রায় ছয়-সাত বছর তারা দিল্লিতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার নায়ক মোশতাক বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়া। সামরিক আইনের বদৌলতে তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পাপের ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছিল। আরেক জেনারেলের হাতে তাকে চট্টগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
রাসেলকে হত্যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের শিশুদের মনে কী প্রভাব পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের লেখক ও সাংবাদিক মিনার মনসুরের একটি বইয়ে। বইটির নাম ‘আমার পিতা নয়, পিতার অধিক’। এই বইতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার ছেলে অদম্যর বয়স এখন ১০। যখন ওর বয়স ৫ বছর তখনই একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে ও আচমকা প্রশ্ন করে বসেছিল-বাবা বঙ্গবন্ধুকে ওরা কেন মেরেছিল?’ এমন প্রশ্নের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম না মোটেও। তাই একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। এও উপলব্ধি করেছিলাম যে, পাঁচ বছরের একটি বাচ্চাকে বিষয়টি বোঝানো মোটেও সহজ নয়। তবুও তার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।
কিন্তু তাতে অদম্য পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যত দিন যায়, ওর প্রশ্নের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে কারা মেরেছে-এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা যখন বলি যে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তারাই তাকে হত্যা করেছে। তখনই সে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, কেন মেরেছে? আমরা বলি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। তাই। তাহলে রাসেলকে মারল কেন? ও তো কিছু করেনি। আমার মা তখন জীবিত ছিলেন। অদম্যর প্রশ্ন শুনে তিনি হেসে বলতেন, তোরা ওর নাম অদম্য রাখলি কেন? ওকে তো আর দমানো যাবে না। আমরা হাসতাম।
অদম্য হয়তো একটু অন্যরকম। ওর কৌতূহলের ধরন হয়তো আর দশটা শিশুর থেকে আলাদা।
তবে এসব প্রশ্ন যে অদম্যর একার নয়, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমাদের মেয়ে আলোকিতা। বয়সে অদম্যর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। দেশি-বিদেশি নানা বই পড়ে? তারও সেই একই প্রশ্ন ছোট থেকে। মিনারের ২১৬ পাতার সুখপাঠ্য এই বইটিতে এ ছাড়াও এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা আমাদের এতদিন অজানাই ছিল। নতুন প্রজন্মের লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা বইটি পড়লে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন বলে আমি মনে করি।
আগেই উল্লেখ করেছি, ইন্দিরা-মুজিবের সম্পর্কের নানা দিক। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা ক্ষমতাচ্যুত হন। জনতা পার্টির নেতা মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। এই সময় তিনি থাকতেন দিল্লির একটি বাড়িতে। আমি তখন দিল্লিতে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছিলাম। তার সঙ্গে আমার পরপর সাত দিন বিকালের দিকে দেখা হয়েছিল। তাকে নানা প্রশ্ন করতাম। একদিন তার টেবিলে একটি ইংরেজি কাগজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের দিল্লি সফরের খবর বেরিয়েছে। তিনি আমাকে তার প্রশাসন, দেশ গঠন, সবুজ বিপ্লব নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম- আপনি বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যা যা বললেন, সে ব্যাপারে আপনার কাছে কোনো কাগজপত্র আছে? এবার উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললেন, তুমি মোরারজি দেশাইকে তো চেন? তার কাছে যাও। আমি কোনো কাগজ নিয়ে আসিনি। সব কাগজ ওখানেই আছে। আমার পরের প্রশ্ন ছিল- আপনি প্রথম যখন বঙ্গবন্ধুকে দেখেন তখন কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? তখন তার চোখ ছলছল করতে লাগল। আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তোমরা ক’ভাই? আমি বললাম, আমরা চার ভাই। আমি ছোট। ইন্দিরাজির শারীরিক ভাষা বদলে গেল। বললেন, আমার এক ভাই। তার নাম মুজিবুর রহমান। তিনি চোখের জল সামলাতে পাশের ওয়াশরুমে চলে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, আমার একমাত্র ভাই। তাকে খুন করেছে আমেরিকা, পাকিস্তান আর চীনের ষড়যন্ত্রে। এবার তিনি বললেন, তুমি কি তার মেয়েদের খবর রাখ? আমি আস্তে আস্তে বললাম, হ্যাঁ রাখি।
সাম্প্রতিককালে আমরা শুনতে পাচ্ছি বাংলাদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও কিছু ব্যবসায়ী নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। ভারতের অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দারাও বলছেন যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা কোনো দিনই আর বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে পারবে না। একাধিক গোয়েন্দা অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা মনে করেন, হাসিনার রাজনীতির হাতেখড়ি তার বাবার কাছে। আর বাবাকে হত্যার পর দিল্লি থাকাকালীন দেখেছেন ভারতের মতো বিশাল দেশ কীভাবে চালাতে হয়। ইন্দিরার এই কাজগুলোও তিনি লক্ষ্য করেছেন। তিনি খুবই দক্ষ হাতে সরকার চালাচ্ছেন। দেশকে সংগঠিত রাখার ক্ষেত্রে তার ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকাও অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে কোনো ষড়যন্ত্রই শেখ হাসিনাকে টলাতে পারবে না বলেই মনে করে এখানকার ওয়াকিবহাল মহল। তিনি বাবারই মতো ষোলোআনা খাঁটি বাঙালি। তার বাবা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি বলেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।