অনলাইন ডেস্ক:
মাউন্ট ভিসুভিয়াসের ঠিক পাশের শহর। আর শহরটার ঈশ্বর হলেন ম্যারাডোনা। ঠিক তেমনটাই মনে করেন সেখানকার মানুষজন। এই ঈশ্বর তাঁদের নিকট দৃশ্যমান ছিলেন কিন্তু সেই ঈশ্বর তাদের ছেড়ে গেলেন সে খবর শুনে শহরের মানুষজন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শোকার্ত হয়ে তারাও যেন মৃত আত্মার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেন তাদের জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এখানে সেখানে বসে পড়েছেন। মুহূর্তেই বিশাল ভবনজুড়ে একদল চিত্রকর বানিয়ে ফেললেন ম্যারাডোনার মুরাল।
তার সামনে ১০ নম্বর জার্সি সার সার করা এক দোকানের মধ্যে ম্যারাডোনার ছবি বসিয়ে সেখানে আলোকবর্তিকা দেয়া হয়েছে। আসলে এই শহরের ইতিহাস আর সংস্কৃতিটাই পালটে দিয়েছেন একজন ম্যারাডোনা।
মারাডোনা তাঁর ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় নাপোলির ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়ে মাঠ মাতিয়েছেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’। আর তাই তো তাঁর সম্মাননায় জার্সিটিই চিরতরে তুলে রেখেছে নাপোলি। এবার তাঁর স্মরণে নিজেদের স্টেডিয়ামের নামটাই পাল্টে ফেলছে নাপোলি। ইতালির ক্লাবটির স্টেডিয়ামের নতুন নাম রাখা হবে ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। নাপোলি প্রেসিডেন্ট অরেলিও ডে লরেন্টিস এই বিষয়টি জানিয়েছেন।
ম্যারাডোনা যখন এই ক্লাবটিতে আসেন তখন এই শহরকে আর এই ক্লাবকে সেই অর্থে কেউ চিনতো না। বার্সেলোনা থেকে যখন ম্যারাডোনা নাপোলিতে আসেন তখন যেন এই উচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল শহরটিতে। ম্যারাডোনা সেই উচ্ছ্বাসকে সার্থক করেছেন। একাই একটি ক্লাবকে পুরো দেশে এমনকী পুরো বিশ্বের কাছে নিয়ে গেছেন।
যার ফলে এই নাপোলিতেই ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা যখন ইতালির মুখোমুখি হয়, নাপোলি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে নিজ দেশ, অন্যদিকে ম্যারাডোনা। দেশপ্রেমের অনড় সীমাটাকে একটু বাঁকিয়ে সেখানে সেদিন ম্যারাডোনাকেও জায়গা দিয়েছিলেন নাপোলিতানরা।
১৯৮৪-১৯৯১ পর্যন্ত নাপোলির জার্সিতে মাঠে নামেন ম্যারাডোনা। নাপোলির প্রতি দিয়েগোর বাড়তি টানের কথা সকলের জানা। স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির মৃত্যুতে মর্মাহত নাপোলি। তারা টুইট করে, ‘সবাই অপেক্ষা করছে আমরা কী বলি তা জানার। যে যন্ত্রণা আমরা অনুভব করছি, তা প্রকাশ করার শব্দ কোথায়? এখন কাঁদার সময়। পরে শব্দ খোঁজা যাবে।’
রেকর্ড ট্রান্সফার মানি নিয়ে ইউরোপে দুবার দলবদল করলেন, নাপোলির মতো নামহীন গোত্রহীন এক দলে যোগদান করে তাদেরকে দিয়ে জেতালেন এক মৌসুমের ট্রেবল! নাপোলিকে দেশসেরা ও ইউরোপসেরা ও বিশ্বসেরা ক্লাব বানালেন ম্যারাডোনা একাই। এই শহরের মানুষ ভুলবে কী করে, তাদের বুকের ভেতর রক্ত ঝরছে এখন।
ম্যরাডোনার মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পরে নাপোলির রাস্তায় ভক্ত সমর্থকরা জড়ো হতে শুরু করে। নাপোলিতে তাঁর বিশাল এক চিত্রকর্মের সামনে হাজার হাজার মানুষ জমা হয়ে স্মরণ করছেন ম্যারাডোনাকে। আর গোটা ফুটবল বিশ্ব কাঁদছে ‘ফুটবল ঈশ্বর’কে হারিয়ে।
নাপোলিতে নাম লেখানো এবং অখ্যাত এক ক্লাবকে সিরি-এ ও উয়েফা কাপ (বর্তমানে চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতানোর দুর্দান্ত গল্পকে ঘিরে তৈরি হয় ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘দিয়াগো ম্যারাডোনা’। এটি নির্মাণ করেছেন ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার আসিফ কাপাডিয়া। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই তথ্যচিত্রটির দৈর্ঘ্য ১৩০ মিনিট। এখানে দেখা যায় ম্যারাডোনার কিছু বিরল ফুটেজ। এটিও কান ফিল্ম উৎসবেও প্রিমিয়ার হয়েছে।
নেপলসের মেয়র লুইগি ডি ম্যাগিস্ট্রিস এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘ডিয়েগো আমাদের মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন, নেপলসকে পুনর্জাগরিত করেছিল ডিয়েগো। তাঁর যাদুতে নেপলসকে জাগিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে তাকে আমরা সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছি। সে নেপলসের একজন নাগরিক। সে আমাদের হাসি খুশি দিয়েছে। আমরা তাকে ভালোবাসি, নেপলস তাকে ভালোবাসে।’