অনলাইন ডেস্ক:
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কমাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে দুই ধাপে দেওয়া বিধি-নিষেধের সুফল মিলতে শুরু করেছে বলে প্রাথমিক মূল্যায়ন করেছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা। এই মূল্যায়নে তাঁরা আপাতত দৈনিক শনাক্ত সূচক বিবেচনায় নিয়েছেন, যা নিচে নামার পর্যায়ে রয়েছে। প্রথম দফার পর গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় লকডাউনের আদলে আট দিনের জন্য কঠোর বিধি-নিষেধ। আজ রবিবার এর পঞ্চম দিন চলছে। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত রয়েছে এই বিধি-নিষেধের মেয়াদ। তবে সংক্রমণ কমার প্রাথমিক সাফল্য আরো জোরদার ও নিশ্চিত করতে চলমান বিধি-নিষেধের মেয়াদ কমপক্ষে এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি বিধি-নিষেধ একেবারে তুলে না দিয়ে ধাপে ধাপে শিথিল করার বিষয়টি মাথায় রাখা হচ্ছে।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক বিশেষজ্ঞ-কর্মকর্তা বলেন, চলমান বিধি-নিষেধের মেয়াদ ২১ এপ্রিল থেকে বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত নেওয়ার ব্যাপারে কাজ চলছে। এর পরে হয়তো অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হবে। তবে আন্ত জেলা যোগাযোগ, পর্যটন, বিনোদনকেন্দ্র, সভা-সমাবেশ, সামাজিক আয়োজন ঈদুল ফিতর পর্যন্ত বন্ধ রাখার পক্ষে জোর দেওয়া হচ্ছে।
সূত্রগুলো বলছে, গত ১৪ এপ্রিল লকডাউনের আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে হওয়া বৈঠকে অন্তত ১৪ দিনের লকডাউনের কথা আলোচনা হয়। এক সপ্তাহ করে তা প্রয়োগ করার কথা ভাবা হয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অন্তত ২১ দিন লকডাউন ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধে সুফল পাওয়া যাবে না বলে সতর্ক করা হয়।
এসব মতামত ও পরামর্শ এবং সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে লকডাউন আরো বাড়ানো হবে কি না, বাড়ালে কত দিন এবং কী মাত্রায় হবে—সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিতে আগামীকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে গত বৈঠকে যে টানা ১৪ দিনের কথা আলোচনা হয়েছে, সে ধারাতেই সরকার এগোবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
গত বৈঠকে উপস্থিত থাকা একজন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার বলেন, চলতি লকডাউন শুরু হওয়ার পর কিছু কিছু বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপাতত লকডাউন না বাড়িয়ে কোনো সমাধান আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে সরকার যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অন্যদিকে কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটিও সরকারকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বর্তমান কঠোর বিধি-নিষেধের সময়সীমা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে। অন্য জনস্বাস্থ্যবিদরাও একই মত দিচ্ছেন কয়েক দিন ধরেই। তাঁদের মতে, এখন যেভাবে শনাক্ত কম থাকছে, সেটা আরো কমাতে হলে আরো এক সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। তা না হলে ২১ তারিখ পর্যন্ত বিধি-নিষেধ রেখে এরপর তুলে দিলে পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘মানুষের বেপরোয়া চলাফেরায় সংক্রমণ ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের তুলনায় লাফিয়ে লাফিয়ে ১০-১২ গুণ বেড়ে গিয়েছিল, শনাক্তের হার ২ শতাংশের ঘর থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে, দিনে ২০০-৩০০ জন থেকে সাত হাজার জনে উঠে গিয়েছিল। ওই সময়ের শনাক্তকৃতদের মধ্য থেকেই এখন মৃত্যু ঘটছে। তবে সরকারের কঠোর বিধি-নিষেধের মাধ্যমে সংক্রমণ বিস্তারের চেইন অনেকটাই ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে গত চার-পাঁচ দিন ধরে শনাক্তও কমেছে। এটা ধরে না রাখলে বিপদ কমবে না, আর ধরে রাখতে হলে এবং সংক্রমণ আরো কমাতে হলে চলমান বিধি-নিষেধ আরো এক-দুই সপ্তাহ বহাল রাখার জন্য আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলছি। অন্য দেশগুলোও একই পথে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এটাও ভাবছি—বেশিদিন সব কিছু বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয় মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে। তাই অন্তত আরো এক সপ্তাহ এখনকার মতো কঠোর অবস্থা রেখে এরপর ধাপে ধাপে কিছুটা ছাড় দেওয়া যায়। পাশাপাশি মানুষ যাতে টিকা দেয় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেটা দেখতে হবে।’
এদিকে করোনা পরিস্থিতি তদারকির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ঢাকায় থেকেও যার যার এলাকায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন ও কার্যক্রমে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। লালমনিরহাট জেলার দায়িত্বে থাকা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেসবাহুল ইসলাম গতকাল বলেন, লালমনিরহাটের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এর পরও সব বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে, যাতে পরিস্থিতির অবনতি না হয়।
গাইবান্ধা জেলার দায়িত্বে থাকা দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, গাইবান্ধা জেলায় এ পর্যন্ত মোট ১৯ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সম্প্রতি শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারা গেছে দুজন। তাই জেলার পরিস্থিতি তুলনামূলক অনেক ভালো আছে। আরো কতটা ভালো রাখা যায় নিয়মিতই সেই চেষ্টা চলছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠক করছি। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি এখনো যে হয়নি তা তো দৃশ্যমান।’
এদিকে রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বিধি-নিষেধের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার সেটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা নেবেন। তবে একজন রোগতত্ত্ববিদ হিসেবে বলব—সংক্রমণ রোধে চলমান আট দিনের বিধি-নিষেধ আরো সাত দিন বাড়ানো দরকার। এর পরও বিধি-নিষেধ একবারে তুলে দেওয়া যাবে না, ধাপে ধাপে ছাড় দিতে হবে। বিশেষ করে আন্ত জেলা যোগাযোগ, পর্যটন, বিনোদনকেন্দ্র, সভা-সমাবেশ, সামাজিক আয়োজন আরো কিছুদিন বন্ধ রাখা দরকার হবে। এর সবটাই মানুষের সুরক্ষার জন্য।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা গত বছরও দেখেছি, যখনই কঠোর কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তখনই সংক্রমণ কমে এসেছে। এবারও এরই মধ্যে আমরা সে রকম সুফল দেখতে শুরু করেছি শনাক্ত কিছুটা হলেও কমে আসার মধ্য দিয়ে। আমরা দেখেছি, কঠোর বিধি-নিষেধের সময়ে মানুষের বড় একটি অংশ যেমন ঘরে থাকছে, তেমনি যারা বাইরে বের হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্তত মাস্ক পরার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে সংক্রমণ বিস্তারের গতি কিছুটা কমছে।