নির্বাচন না আন্দোলন, এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা, হিসাবনিকাশ। নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ও তার মিত্ররা এতে সন্তুষ্ট নয়।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। পুলিশ বাহিনী এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। বিভিন্ন স্থানে খুন, রাহাজানি, ছিনতাই কিছুটা কমলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আর বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম অনভিপ্রেত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এ রকম পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী দিনরাত একাকার করে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তারপর মব, লুটপাটও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বাড়ছে খুন, ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ। এ রকম একটি ভঙ্গুর সময় বিএনপির মতো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল যদি আন্দোলনে যায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এটি কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল করতে পারে না বলেই জনগণ বিশ্বাস করে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পোশাক খাতের বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কার্যাদেশ বাতিলের চিঠি পাচ্ছে। কেউ কেউ কার্যাদেশ স্থগিত করছে। এ বাড়তি শুল্ক সামাল দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। এতে পোশাক খাতে একটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এমনিতেই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশ কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শ্রমিক ঈদে বেতন-বোনাস পাননি। পোশাক খাত যখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন মার্কিন এ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ধরনের হুমকি। তা ছাড়া সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রটাও ভালো না। আমাদের অর্থনীতিতে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন প্রবাসী ভাইবোনেরা, যারা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি মোটামুটি একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রেখেছেন। কিন্তু আমরা সবাই জানি, শুধু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়ে একটি দেশের অর্থনীতি সচল এবং ভালো থাকতে পারে না। এ কারণে আমাদের রপ্তানি আয় যেমন বাড়াতে হবে, তেমন দেশি শিল্প উদ্যোক্তা এবং বেসরকারি খাত সচল করতে হবে। কিন্তু বেসরকারি খাত এখন পর্যন্ত সচল হয়নি। সরকার তাদের আস্থায় নিয়ে আসতে পারেনি। অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা জটিলতার কারণে কেউ কেউ ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন না। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এ অবস্থা অর্থনীতির জন্য অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো ধুঁকছে। অর্থনীতির গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ সময় আইএমএফের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। তারা বাংলাদেশের জন্য যে ঋণ বরাদ্দ করেছিল তার কিস্তি ছাড় দেবে কি না তা নিয়ে এখন সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণখেলাপি কমিয়ে আনা এবং কর বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। আইএমএফের ঋণ পেতে বাংলাদেশকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে যেতে হতে পারে। এ ধরনের সংস্কার অর্থনীতির ওপর সাময়িকভাবে হলেও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে কারও কারও শঙ্কা। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে। দ্রব্যমূল্যের কিছুটা লাগাম টেনে ধরলেও চালের দাম নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়তির দিকে। এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতির গতিপথ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে এগোচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোয় বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহের স্বাভাবিকতা নিয়েও সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশ এখন একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো নতুন করে কথা বলা শুরু করেছে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা হয়েছে বটে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমন্ড লে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে একটি মনগড়া অপপ্রচার এখনো সচল। পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রবাদীদের আস্ফালন লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তির সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টা দৃশ্যমান। বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থানকে বদলে কেউ কেউ এটিকে জঙ্গিবাদের উত্থান হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছে। এ ধরনের ঘটনা সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরাজিত ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি নতুন করে আন্দোলন করে তাহলে একদিকে যেমন হিযবুত তাহ্রীরের মতো উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী সুযোগ পাবে, অন্যদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নতুন করে ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপির আন্দোলন জুলাই বিপ্লবের সব অর্জন নষ্ট করতে পারে। বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলনের ফলে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় সেটি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটা নতুন চাপের মধ্যে ফেলবে বলে অনেকে মনে করেন। এ বাস্তবতায় বিএনপি যা-ই করুক না কেন, তাদের দেশের কথা চিন্তা করতে হবে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য বিএনপির দায়িত্বই এখন সবচেয়ে বেশি। গত আট মাসে বিএনপি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা সরকারের সঙ্গে একদিকে যেমন আলাপ-আলোচনা করছে, অন্যদিকে বিরুদ্ধমতের সঙ্গে যুক্তিভিত্তিক বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এটি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে। আর সে কারণেই বিএনপির ধৈর্যহারা হলে চলবে না। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ ১৭ বছর তারা ধৈর্য ধরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এ রকম কোনো মনোভাব দেখা যায়নি যে, তারা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকতে চায় বা এ রকম কোনো অভিপ্রায় আছে, বরং প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সবাই নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেওয়ার কথা বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু বাংলাদেশই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কাজেই তাঁর ওপর আস্থা রাখতেই হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থাশীল থাকার কথা বলেছেন। তবে প্রধান উপদেষ্টার ওপর যদি বিএনপি আস্থা হারায় এবং রাজপথে আন্দোলন করে সেটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য হবে এক ধরনের অশনিসংকেত। এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ যেমন ব্যাহত হবে, তেমন বাংলাদেশ পথ হারাবে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নিশ্চয় এ রকম কোনো কিছু করবে না।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।