Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
আধুনিকতা নাকি বিকৃত উচ্চারণ
--জবি প্রতিনিধি

আধুনিকতা নাকি বিকৃত উচ্চারণ

কলামিস্ট আব্দুল্লাহ আলম নুর

প্রতিবছর আমাদের দেশে নানা আয়োজনে উদযাপিত হয় মহান শহিদ দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতির আগ পর্যন্ত এই দিবসের নাম ছিলো শহিদ দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলা এমন একটি ভাষা যার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য বিসর্জন দিতে হয়েছিল বুকের তাজা খুন। যে ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গণদাবি ওঠলে, লিখালিখি আর সমর্থন ওঠলে ভীত শাসকগোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করেছিল, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সবধরনের মিছিল-সমাবেশের উপর। তবু সেদিন দমে যায়নি ছাত্র-জনতা। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গন থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়েছিল, মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজেদের তরুণ জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। নিজেদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেক মুক্তিকামী নওজোয়ান। মূলত আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
এবং ভাষা শহিদগণের আত্মত্যাগের প্র‍তি সম্মান প্রদর্শন করেই, এই
দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ
এবং আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত আমাদের মাতৃভাষা।

কিন্তু আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করছি, কতটুকু সম্মান প্রদর্শন করছি তাদের
সেই ত্যাগের প্রতি! এখনো কি রাষ্ট্রীয় দপ্তর, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবখানে বাংলা ব্যবহার করছি? সঠিক বাংলার চর্চা করছি? ভাষার বিকৃতি রোধ করতে পারছি? আমাদের এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ভূখণ্ডে বারবার ভীনদেশীদের শাসনের স্বীকার হয়েছিল, ভীনদেশীরা শাসন করেছিল, শোষণ করেছিল। আমাদের সম্পত্তি নিয়ে, আমাদের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত লভ্যাংশ নিয়ে সমৃদ্ধ করেছিল নিজেদের দেশ। ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান, তার আগে ১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশরা শাসন করেছিল এই শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ডে। কিন্তু আজ আমরা স্বাধীন, আমাদের ভূখণ্ড স্বাধীন। তবু
এদেশের বেশিরভাগ স্তরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে
ভীনভাষার প্রয়োগ রয়েই গেছে। নিজ ভাষার প্রতি এমন অবহেলা দেখলে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশ থেকে ঔপনিবেশিকদের মূলোৎপাটন হলেও এর প্রভাব থেকে গিয়েছে, আমাদের রাষ্ট্রীয় দপ্তর-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দৈনন্দিন কর্মপরিচালনায়! একসময় ফারসি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা ছিল, সে ভাষা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হলেও দাপ্তরিকভাবে ইংরেজি ভাষার হাত থেকে আমাদের মুক্তি
মেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান হচ্ছে ইংরেজিতে, পঞ্জিকা অনুসরণ করা হচ্ছে ইংরেজি সনের, চিকিৎসকগণ ব্যবস্থাপত্র লিখছেন ইংরেজিতে। তাদের অস্পষ্ট অক্ষরের কারণে সৃষ্ট ভোগান্তির কথা রোগী, ওষুধ বিক্রেতা কারোরই অজানা নয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নাম, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদবি লিখা বা উল্লেখ করা হয় ইংরেজিতে।

নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে বিদেশি ভাষার দিকে
ঝুঁকছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফেসবুক-মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। বিদেশি ভাষার সঙ্গে বাংলাকে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে। অনেকে আবার বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে ভাষার অবস্থা করছে জগাখিচুড়ির মতো। বর্তমানে লক্ষণীয়, এফএম বেতার, টিভি, অনলাইন, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমের প্রভাবে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে কেমন যেন একটি মিশ্র ভাষারূপ তৈরি হচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর মাত্র কয়েকটি বাদে সবই ইংরেজি নামে চলছে, সরকার চাইলেই (মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন প্রস্তাব করতে পারে) সেগুলোর বাংলা নাম দেয়া সম্ভব। শুধু নামই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রমও ইংরেজি ভাষাতেই চলে। এমনকি মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাংলা শব্দের উচ্চারণেও পরিলক্ষিত হচ্ছে ভিন্নতা। এফএম এবং ইউটিউবে প্রচারিত বিভিন্ন অডিও, ভিডিওর আগ্রাসনে তথাকথিত আধুনিকদের মুখে ‘র’ উচ্চারিত হচ্ছে ‘ড়’। বরং যারা ভিন্ন ভঙ্গিতে বাংলা উচ্চারণ করে না, কথায় কথায় ইংরেজি বলে না, তারাই হয়ে যায় সেকেলে, এ তো আধুনিকতার নামে বিকৃত উচ্চারণ। অন্যদিকে বড় সমস্যা ভিন্ন ভাষায় প্রচারিত সিরিয়াল, কার্টুনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো, যা দেখে নতুন প্রজন্ম সেগুলোরই চর্চা করছে। অন্য ভাষায় প্রচারিত কার্টুন দেখে সে ভাষায়ই অভ্যস্ত
হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভিন্ন ভাষার এই ডোরিমন কার্টুনটি যে শিশুদের ভাষা শিক্ষা এবং সামাজিক বিকাশ নিয়ে অভিভাবকদের কপালে একটি চিন্তার রেখা ফেলে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

আজকাল শহর অঞ্চলের অনেক অভিভাবকই বাসায় শিশুর ইংরেজি কথোপকথন দক্ষতা বাড়াতে অনবরত ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। ফলে এই শিশুর কাছে আমাদের শ্রুতিমধুর বাংলা শব্দগুলো হয়ে উঠছে দুর্বোধ্য, রয়ে যাচ্ছে অপরিচিত। বাংলা ভাষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যা মোটেও সুখকর নয়।

ভীনদেশি ভাষাকে আমরা অনেকক্ষেত্রে এমন অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছি, যেন ওই ভাষা ছাড়া আমাদের কথা বলা সম্ভব নয়, জীবনযাপন সম্ভব নয়। একথা সত্য যে, বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে যোগাযোগের উপায় হিসেবে ইংরেজি ভাষার স্থান ওপরে। ইংরেজি ভাষার এই আধিপত্য বিস্তার সম্ভব হয়েছে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক যাত্রার কারণে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি বা দেশ রয়েছে যারা ইংরেজি ভাষার প্রবল প্রতিপত্তিকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষায় রাষ্ট্রীয়, দাপ্তরিকসহ সব কাজ সম্পন্ন করছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘রাষ্ট্র….জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন্#৩৯;। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শতভাগ চালু নেই বাংলাভাষা। উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনা, চাকরির ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশ্নের চেয়ে ইংরেজিতে বা ইংরেজি সংক্রান্ত প্রশ্নই বেশি করা হয়।
বাংলাদেশে যে কোনো ভাষা ব্যবহারের সুযোগে বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষা
যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেসব বিদেশী ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তা হল যথাক্রমে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা। বিদেশি ভাষাগুলো বাংলা ভাষার তুলনায় মর্যাদা ও কার্যকারিতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে অনেক গর্ববোধ করি। অথচ
দুঃখজনক বিষয়, আমরাই আধুনিকতার নামে কার্যত দিনদিন মাতৃভাষা চর্চাকে নিরুৎসাহিত করছি বিভিন্নভাবে। এ ভাষার রয়েছে আত্মপরিচয় ও গৌরব উজ্জ্বল এক ইতিহাস। সেই মূল্যবান গৌরবগাঁথা সোনালি অধ্যায়ের কোনো অসম্মান এই জাতি কী করে মেনে নিবে! কীভাবে এর অপব্যবহার মেনে নিজেকে ছোট করবে? এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রের নিকট প্রত্যাশা থাকবে, সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং এর চর্চায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা কার্যকর হোক। বিশ্ব দরবারে সমৃদ্ধ হোক, গুরুত্বপূর্ণ আসন অলংকৃত করুক বাংলা ভাষা।

 

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply