অনলাইন ডেস্ক:
স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে সরকারগুলোর নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তি করতে পারাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সামরিক হস্তক্ষেপ, আন্দোলন, সহিংসতার মধ্য দিয়ে টেনেহিঁচড়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি একবার ক্ষমতায়, আরেকবার বিরোধীরা—এই ধারাকে গত এক যুগে বদলে দিয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উন্নয়নকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে দলটি টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান মেয়াদের দুই বছর পূর্তি আজ। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার এক যুগ পূর্ণ হলো। এ সময়কালে সরকারের সাফল্য, ব্যর্থতা, অর্জনও অনেক। আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই এ দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন হতে যাচ্ছে। আবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিববর্ষ হিসেবে উদযাপনও হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বেই। সরকারবিরোধীরা দেশে গণতন্ত্র না থাকার অভিযোগ তুললেও দেশের যে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই কারো।
একসময় বিদ্যুতের ব্যাপক সংকট ছিল। প্রতি ঘণ্টায় একাধিকবার লোড শেডিং হতো। দেশে এখন বিদ্যুতের সেই সংকট নেই। বাংলাদেশ এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশের আট বিভাগকেই ফোর লেনের সড়ক যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র বদলে গেছে এ দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির ফলে। বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন এ সরকারের একটি বড় অর্জন। গত কয়েক বছরে মাথাপিছু গড় আয় অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার। এখন তা এক হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। এ বছর ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের আগেই এ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
যানজট নিরসনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকায় কাজ চলছে মেট্রো রেলের। কাজ চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েরও। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। মহাকাশেও নিজের অবস্থান জানান দিয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ গত এক বছরে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বেশ কয়েকটি মেগাপ্রজেক্টের কাজও এগিয়ে চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ আরো কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।
গত এক যুগে নানা রাজনৈতিক সহিংসতা, ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে সরকারকে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এক-এগারো পরবর্তী সেই কঠিন সময়ে সরকার পরিচালনা ও দলকে সুসংগঠিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ বেশ ভালোভাবেই উতরে যায় আওয়ামী লীগ। সরকারের শুরুতেই বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটি ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে অনেক বেগ পোহাতে হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বিএনপি জোট। বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করে আবারও ক্ষমতায় যাওয়া এবং সরকার পরিচালনা করতে পারা অনেক দুরূহ কাজ ছিল। সেখানেও সফল হয় সরকার।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নেতাকর্মী জমায়েত হয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। সে সময়ে ওই গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে সফল হয় সরকার।
এ ছাড়া দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শাস্তির পর তাঁকে কারাবন্দি করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জ তারা সফলভাবে সামাল দিয়েছে। এর বাইরে দেশি ও বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই সরকার দেশকে একটি স্থিতিশীল জায়গায় আনতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থার ওপরে প্রথম বড় আঘাত আসে। এর পর থেকে দেশের রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তী সময়ে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করলেও কেউই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এরশাদ সরকারের পতনের পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। সর্বশেষ ২০০৬ সালেও ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতায় অচলাবস্থা তৈরি হলে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আলোচিত এক-এগারো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো দল টানা তিন মেয়াদে দেশ শাসন করছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, ধারাবাহিকভাবে সরকার ক্ষমতায় থাকায় দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার কারণেই বিশ্বের কাছে এখন উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘টানা এক যুগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি অনন্য উদাহরণ। এ দেশের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থনের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি উন্নয়নশীল দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হব।’
বিরোধীদের অভিযোগ গণতন্ত্র সংকটের
গত এক যুগ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশে গণতন্ত্র সংকটে রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সরকারবিরোধীরা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান ও দলের যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ১২ বছর ধরে এই সরকার জবরদখল করে ক্ষমতায় টিকে আছে। এই ১২ বছরে তারা দেশের, গণতন্ত্রের, জনগণের যে ক্ষতি করেছে তা তারা অনুধাবন করতে পারছে না। তারা তা করতে পারবেও না। দেশের সব দল ও জনগণের এই সময়ে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই দখলদারী সরকারকে এখনই সরিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার করা এবং একটি নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ভুয়া ভোটে নির্বাচিত বর্তমান সরকার লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির স্বার্থরক্ষায় কাজ করছে। তারা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে সমঝোতার নীতি গ্রহণ করেছে। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। তিনি আরো বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশে যে আকাঙ্ক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে চলছে এই সরকার, যা বিএনপি-জাতীয় পার্টির থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বাম বিকল্প শক্তিকে শক্তিশালী করা দরকার।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সরকার সব ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করেছে। সরকারের কর্মকাণ্ডে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সামনে রেখে চিহ্নিত রাজাকারদের বাইরে রেখে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।