অনলাইন ডেস্ক:
২০ মার্চ, ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিবস। দেশের পরিস্থিতি উত্তাল থেকে আরো উত্তাল হচ্ছে। মুক্তিকামী বাঙালি সেনাবাহিনীর ভয়ভীতিকেও আর পরোয়া করছে না। সরাসরি মোকাবেলা করতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে অবাঙালিদের সঙ্গেও দাঙ্গা বাধছে। মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর, সৈয়দপুরে বিহারি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।
মুক্তিপাগল মানুষের জাগরণে রাজধানীর অবস্থাও টালমাটাল।
মিছিলের পর মিছিল জমায়েত হচ্ছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শপথ গ্রহণ শেষে তারা মিছিল নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাসভবনে। মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠা নেতাও তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনো শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক নৌসেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। খ্যাতিমান শিল্পী-সাহিত্যিকরা পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সম্মানসূচক খেতাব ত্যাগ করেন। শুধু তা-ই নয়, সশরীরে নেমে আসেন রাজপথে। ২০ মার্চ চারু ও কারুশিল্পীরা হাতে লেখা পোস্টারে ‘স্বা ধী ন তা’ লিখে বুকে বেঁধে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁদের এ মিছিল সংগ্রামী জনতার মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছয়জন শীর্ষ সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন এ কে ব্রোহী, শরীফুদ্দিন পীরজাদা ও কর্নেলিয়াস। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, সময় এলে অবশ্যই আমি সব কিছু বলব।’
আন্দোলনের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের স্বাধীন জাতি কিভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘২৩ মার্চ লাহোর দিবস উপলক্ষে ছুটি থাকবে সারা বাংলাদেশে। ১৪ মার্চ ঘোষিত নির্দেশ ও ব্যাখ্যামতো সব কিছু চলবে। আগামী দিনে যেসব নির্দেশ দেওয়া হবে সেমতে সব কর্মসূচি পালন করতে হবে।’
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা দিলেন, ২৩ মার্চ স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস হিসেবে পালিত হবে। চট্টগ্রামে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ দিতে ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানানো হয়।
করাচিতে পিপিপি নেতা ভুটো সাংবাদিকদের জানান, তিনি আগামীকাল ঢাকা আসছেন। প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে সন্তোষজনক জবাব পেয়ে তিনি ঢাকা বৈঠকে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।