রাজিব শর্মা, চট্টগ্রাম: সারাবিশ্বে সমগ্র বিশ্ববাসী যাদুঘর দিবস পালন করেন। অতীতের সোনালী কিংবা ব্যর্থতা যাই হোক তা সহজ সরল ও বস্তুনিষ্ঠ ভাবে মিউজিয়াম কিংবা যাদুঘরে সংরক্ষিত হয়। সেই মিউজিয়াম থেকে জাতি তার অতীত ইতিহাস জানেন। উন্নত প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসী এ দিবসটি মহা আনন্দের সাথে পালন করে। আমাদের বাংলাদেশে সাদামাটাভাবে পালিত হয়। অবশ্যই ঢাকায় জাতীয় যাদুঘর দিবসটি মযার্দার সহিত পালন করে। বলা হয় একটি যাদুঘর হাজার হাজার বছর পরও জাতির ইতিহাস প্রজন্মের সামনে উপহার দেয়। সেক্ষেত্রে যাদুঘরের ভূমিকা অপরিসীম। চট্টগ্রামকে বলা হতো হাজারো বছরের চট্টগ্রাম। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে ইতিহাস গবেষণা, ইতিহাস গবেষকদের প্রাপ্ত অনুসন্ধানী তথ্য উপাত্ত্বের মধ্যে দিয়ে প্রমানিত হয়েছে এ প্রাচীন চট্টগ্রাম নগরীতে আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগেও মানব বসতি ছিল। প্রাচীন এ চট্টগ্রাম বাসীর ইতিহাস ঐতিহ্য সময়ের উপযুক্ততায় ধরে এগিয়ে চলছে বিশ্ব দরবারে। হয়তো ইতিহাস গবেষকদের মেধা ও মনন যুক্ত আলোচনা ও গবেষণায় একদিন বিশ্ব দরবারে গৌরবের আসনে আসীন হবে এ চট্টগ্রাম।
বিশ্বে আলোচিত প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতের বিভিন্ন শ্লোকে আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ও কাঞ্চননাথের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। আর সেই আদিনাথ, কাঞ্চননাথ ও চন্দ্রনাথের অবস্থান চট্টগ্রাম সীতাকুন্ড, ফটিকছড়ি ও কক্সবাজারের মহেশখালীতে। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ তিন স্মৃতির স্মারক অযত্নে অবহেলায় ধ্বংসের প্রহর গুনছে। রাষ্ট্রের সার্বিক সহযোগিতা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ বিহীন এ ইতিহাসের স্মারক রক্ষা করা অসম্ভব। আমাদের দেশে ইতিহাস সচেতনতার অভাবে অনেক প্রাচীন প্রতœ সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারি আইনও সীমাবদ্ধ। আইনের দুর্বলতার কারণে অনেক ভূমিদস্যু প্রাচীন সম্পদ নষ্ঠ করে অবৈধ ভূমি দখল করে অন্য কিছু তৈরি করছে। একটি জাতির ইতিহাস হত্যাকারীর বিচারের সাজাও নগন্য। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের পক্ষে ইতিহাস গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ-দীন ও ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম ও গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষে অধ্যাপক এম. আর মাহবুব ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বরাবরে স্মারক লিপি ও জাতীয় সংসদের মাননীয় ডেপুটি স্পিকার জনাব কর্নেল অব. শওকত আলীর সাথে তাঁর সরকারী সংসদের অফিসে সাক্ষাৎ পূর্বক বাংলাদেশের প্রতœ আইন সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা ও যুগোপযুক্ত আইন পাশের দাবি জানান। কর্নেল অব. শওকত আলী বিষয়টি সংসদে প্রস্তাব ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দেন। এরপর সুফল হিসেবে ৫ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশ হয় ‘‘আইনের খসড়া প্রস্তুতি-প্রত্নতত্ব সম্পদ ধ্বংসের সাজা ১০ বছরের কারাদন্ড।” এ বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ নীতিগত অনুমোদন পেলেই প্রস্তাবিত প্রত্নতত্ব আইনটি বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষণে এটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে। চট্টগ্রামের মানুষ রাজনীতি, সমাজনীতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও চট্টগ্রামের সাথে বিমাতা সুলভ আচারণ অনেক দিনের। চট্টগ্রামকে আর কতকাল অবহেলার চোখে দেখতে হবে। হাজার-হাজার বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত চট্টগ্রাম পদে পদে বঞ্চনার ডাক। আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো ধ্বংস হতে চলেছে, সংরক্ষণ-সংস্কারের সরকারি কোন উদ্যোগ নেই। চট্টগ্রামের প্রাচীন প্রত্নতত্ব নিদর্শনগুলো জরুরিভাবে সংরক্ষণ করা খুবই দরকার। দেশের ৬৪টি জেলার ঐতিহাসিক প্রত্মসম্পদ সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগের ব্যবস্থা হলে ও চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার এ-৫টি জেলাতে মাত্র ১টি মসজিদ (বকশী হামিদ মসজিদ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম) কে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটিও বর্তমানে প্রত্নতত্ব আইন অমান্য করে মসজিদের দরজা ও ফ্লোরে আধুনিক টাইলস লাগানো হলেও সরকারি ঐ সংস্থা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকারি সংরক্ষণকৃত ঐ মসজিদ হলো বাঁশখালী উপজেলার ইলশা গ্রামের বকশী হামিদ মসজিদ। আমাদের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের প্রাচীন প্রত্মনিদর্শনগুলো সংরক্ষণ, নিয়ম মোতাবেক সংস্কার ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার প্রকাশ করতে পারলে চট্টগ্রামের গৌরব ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বহির্বিশ্বের পর্যটকের আগমন ঘটবে ফলে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নও সম্ভব। উন্নত বিশ্বের প্রায় দেশে সে জাতি ও দেশের ঐতিহ্য রক্ষা ও সংরক্ষণ করে আসছে। আমাদের চট্টগ্রাম বারে-বারে আজ অবহেলিত? নাকি সরকারের ঐ বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাফেলতি? আমি ব্যক্তিগতভাবে নিচে উল্লেখিত প্রত্নসম্পদ সমূহ পরিদর্শন করে তার আলোকচিত্র ধারণ করেছি এবং দেশে বিদেশে চট্টগ্রামের প্রাচীন এই চিত্রগুলো নিয়ে উনিশটি একক চিত্রপ্রদর্শনী করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছি। বর্তমান অবস্থায় সংরক্ষণ ও আইনে সংস্কার করা না হলে খুব অল্প সময়ে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবের অনেক প্রাচীন নিদর্শন।
এই প্রবন্ধে কিছু চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন নিদর্শনের নাম ও ঠিকানা সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রদত্ত হলো:
১) পরাতরী মন্দির, বৌদ্ধ শাসন আমলে নির্মিত, হাইদগাঁও পটিয়া, চট্টগ্রাম। ২) জৈন রাজার রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ৩) আধু খাঁর বাড়ি ও মসজিদ, দোহাজারী, চাগাচর, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ৪) তেরজুরী, প্রাচীন টাকার ব্যাংক ও আলী আকবর মসজিদ, আলমদরপাড়া, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৫) কুরাকাটানী মসজিদ বা লাকশা মসজিদ, পশ্চিম পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৬) হাবিলাসদ্বীপ প্রাচীন শত বর্ষীয় জোড় মন্দির, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ৭) অর্দার বাড়ি, (ঐহিহাসিক জমিদার বাড়ি) তৈওরী হাট, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম। ৮) আধু খাঁর প্রাচীন মসজিদ, জঙ্গল পাহাড়, চুনতি, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম। ৯) বোমাং হাট জামে মসজিদ, বোমাং রাজার হাট, বাজালিয়া, চট্টগ্রাম। ১০) বিখ্যাত জমিদার যুগেশ বাবু রায় বাহাদুরের ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজবাড়ি, আনোয়ারা চট্টগ্রাম। ১১) প্রসন্ন বাবুর রাজবাড়ির তোরণ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১২) ঐতিহাসিক প্রাচীন মন্দির (নরসিং মন্দির), ইতিহাসবিদ ড. সুনীতি কানুনগোর মতে এটি ভারত মহাদেশের সবচাইতে প্রাচীন মন্দির, ইতিহাসবিদগণ কেউ কেউ এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় অতি প্রাচীন মন্দির বলে অভিমত প্রকাশ করেন, পরৈকোড়া, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৩) ঐতিহাসিক মনুমিয়া মসজিদ, বাংলার লোক সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল মলকা বানু-মনু মিয়ার স্মৃতি জড়িত মসজিদ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৪) বিখ্যাত চাঁদ সওদাগরের দিঘি, হিন্দু ধর্মীয় আদি মনসার পুঁথিতে উল্লেখিত সেই দিঘি, দেয়াং পাহাড়, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৫) মোহছেন পীরের পাথর ও শিলালিপি, (মোহছেন আউলিয়া (র.), মোহছেন পীর চট্টগ্রামের মুসলমান আগমনকারী ৩য় ব্যক্তি, তাঁরই পাথর ভাসা সেই পাথর ও শিলালিপি আজও অবহেলিত পাঠোদ্ধার বিহীন অবস্থায় তাঁর মাজারে আছে, আনোয়ারা, রুস্তমহাট, চট্টগ্রাম। ১৬) ছুরত বিবির মসজিদ ও দিঘি, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। ১৭) বিখ্যাত ধর বাড়ি, রাউজান চট্টগ্রাম। ১৮) ইলিয়াছ খাঁর মসজিদ ও রাজবাড়ি, পশ্চিম পটিয়া, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম। ১৯) বুড়া গোসাই, বৌদ্ধধর্মীয় প্রাচীন মন্দির, ছনহরা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ২০) খান মসজিদ ও কদম রসুল (সা) ঐতিহাসিক প্রাচীন মসজিদ ও নবি করিম (সা.)র পায়ে চিহ্ন’র ছাপ এখানে এনে স্থাপন করা হয়, বাগিচার হাট, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ২১) বদরপীরের প্রাচীন তোরণ, বদর পীরের সমাধি, বকশির হাট, চট্টগ্রাম। ২২) কাতাল পীরের প্রাচীন দরগাহ, এটি চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাচীন স্থাপনা, বলা হয় বদর পীর, কাতাল পীর ও মোহছেন পীর এ তিন জনেই চট্টগ্রামের মুসলমান আগমনের প্রথমসারীর মিশনারী, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম। ২৩) নবাব ওয়ালিবেগ খাঁ মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম। ২৪) হামিদুল্লাহ খাঁ মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম। ২৫) বশির উল্লাহ খা মসজিদ, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম। ২৬) আরকান সোসাইটি প্রাচীন মসজিদ, বহদ্দারহাট, চট্টগ্রাম। ২৭) প্রাচীন বুড়া মন্দির, মাস্টার দা সূর্যসেন পল্লী, রাউজান, চট্টগ্রাম। ২৮) পেলা গাজী মসজিদ ও দিঘী, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। ২৯) কাজী মসজিদ, ফটিকছড়ি, ৩০) হাসমত মিয়ার জল্লাত বাড়ি, ফাঁসিখানা, মসজিদ ও দিঘি, ভূজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। ৩১) সোলতানি আমলের ফকিরা মসজিদ (গায়েবী মসজিদ) হাটহাজারী সদর, হাটহাজারী। ৩২) সাহা বাড়ি, সংগীত পরিচালক সত্য সাহার পূর্ব পুরুষদের প্রাচীন জমিদার বাড়ি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। ৩৩) বিখ্যাত জমিদার নন্দী বাবুর বাড়ি, মন্দির ও দিঘি, নন্দীর হাট, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। ৩৪) শাহাজাহান আউলিয়ার দরগাহ ও তোরণ, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম। ৩৫) ঐতিহাসিক বদলমুন্সি জামে মসজিদ, সাধনপুর, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম। ৩৬) সুলতানী আমলের হাম্মাদিয়া মসজিদ, মজ্জিদ্দা, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম। ৩৭) বানিকগ্রাম, হরিগাছতলা হাজার বছরের প্রাচীন বুড়া মন্দির, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম। ৩৮) কদম মোবারক মসজিদ ও কদম রসুল, মোমিন রোড়, চট্টগ্রাম।
আন্দরকিল্লাহ্ শাহী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম। ৪০) হিন্দু ধর্মীয় সভ্যতার অতি প্রাচীন নিদর্শন সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ফটিকছড়ির কাঞ্চননাথ মন্দির ও বোয়ালখালীর হিন্দু ধর্মীয় প্রথম দুর্গাপূজার স্থান কড়লডেংগা মেধস মুণি’র আশ্রমকে স্ব-স্ব অবস্থায় সংরক্ষণ ও হিন্দুদের জাতীয় তীর্থ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। ৪১) হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, পাহাড়, মসজিদ ও পুকুর, বায়েজিদ, চট্টগ্রামসহ চট্টগ্রামের অনেক পুণ্যভূমি এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। হয়নি এখনও ব্রিটিশযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত জালালাবাদের বিখ্যাত সেই পাহাড়