অনলাইন ডেস্ক:
রাজনীতিতে সাপ ধরার খেলা দেখালেন শেখ হাসিনা। প্রথমে সাপকে ক্রমাগত ছোবল মারতে দেওয়া, পিছু হটা। তারপর সাপের গুহায় ধোঁয়া সৃষ্টি। অবশেষে নির্জীব সাপকে ধরে ফেলা। হেফাজতের নেতা বহুবিবাহিত, বহু বিতর্কিত মামুনুল হককে ধরে ফেলার ব্যাপারে এটাই ঘটেছে। ৩০০ পুলিশ গিয়েছিল তাঁকে গ্রেপ্তার করতে। তারা হয়তো ভয় পেয়েছিল। মামুনুল হক জাঁদরেল নেতা। তাঁকে ধরতে গেলে কাতারে কাতারে মাদরাসাছাত্র হয়তো প্রতিবাদ জানাতে বেরিয়ে আসবে। তেমন কিছু হয়নি। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হেফাজত নেতাকে ধরতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
কিছুকাল ধরেই হেফাজত নেতাদের কার্যকলাপ ও কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল হেফাজত দেশে একটা পাল্টা সরকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। হাসিনা সরকার তাদের কাছে নতজানু। তারা ইসলামের যে মনগড়া ব্যাখ্যা দেবে, সেই ব্যাখ্যাই দেশের মানুষকে মেনে চলতে হবে। মামুনুল হকের ধৃষ্টতা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। ওয়াজ মাহফিলে নিজের হাবভাব, মুখভঙ্গিকে তিনি রাসুল (সা.)-এর হাবভাব ও মুখভঙ্গি বলে দাবি জানাতেন।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও বিতর্কিত। তিনি যে মহিলাকে নিয়ে রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েন, তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করলেও তাঁর দাবির প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তাঁর এই গোপন বিয়ে অথবা গোপন সম্পর্কের কারণ দর্শাতে গিয়ে বানোয়াট হাদিস বলে পবিত্র হাদিসের অবমাননা করেছেন। বলেছেন, স্ত্রীকে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলা হলে পাপ হয় না।
হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল এবং হেফাজত নেতা আল্লামা শফীর মৃত্যুর (তাঁর মৃত্যুর কারণও রহস্যাবৃত) পর বাবুনগরী, মামুনুল হক প্রমুখ ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব জবরদখল করে (আল্লামা শফীর পরিবার ও অনুসারীরা এই নেতৃত্ব মানেন না) সংগঠনটিকে জামায়াতে ইসলামীর অনুরূপ ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত করার চেষ্টা শুরু করেন। বলা চলে, জামায়াত আল্লামা শফীর সংগঠনটিকে দখল করে নেয়। হালে মামুনুল হক তাঁর কিছু অনুসারীসহ হয়ে ওঠেন এই সংগঠনের জঙ্গি মুখপাত্র। জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার উসকানি ও নির্দেশ দিয়ে নতুন হেফাজতের সন্ত্রাসী সংগঠনরূপে আত্মপ্রকাশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর নামে এই নব্য হেফাজতিরা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, তারা এই উপমহাদেশখ্যাত সংগীতসম্রাট, সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মরণে নির্মিত ঐতিহাসিক জাদুঘর ভেঙে তছনছ করেছে। জাতির এই ক্ষতি অপূরণীয়।
মামুনুল হক ও তাঁর অনুসারী হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁরা ধর্মদ্রোহী। ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দিয়ে তাঁকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কথাবার্তা বলেছেন, কাজ করেছেন। তাঁরা জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার উসকানিদাতা। তাঁরা রাষ্ট্রের চার মূল আদর্শের শুধু বিরোধী নন, তার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ চান। সে জন্য তাঁরা সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন এবং নিতে চান। তাঁরা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার উসকানিদাতা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর দল। মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তো ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে সন্ত্রাস সৃষ্টির দায়েও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা, জাতির পিতার ভাস্কর্যের অবমাননা, ধর্মান্ধতা প্রচার, সন্ত্রাস সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো ইত্যাদি কারণে হেফাজতকে দমনের দাবি আমরা অনেকে আগেই তুলেছিলাম। এখন বোঝা গেল সরকারেরও সেই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কৌশলগত কারণে দেরি করেছে। সাপকে ফণা তুলতে দিয়েছে। তারপর ফণার ওপর আঘাত করেছে। এটা মোক্ষম আঘাত। যেসব জামায়াতি হেফাজতের তকমা লাগিয়ে পুরনো খেলা খেলছিল, তাদের খেলাও এবার শেষ হবে। বিএনপি—যারা এই সাপের ঝাঁপিতে লুকিয়ে তাদের নতুন খেলা খেলছিল, তাদের সেই খেলাও বন্ধ হবে। এখন তারা হয়তো মামুনুল হক ও অন্যান্য হেফাজত নেতার গ্রেপ্তারকে দেশে সরকার বিরোধিতার ওপর দমন-পীড়ন হচ্ছে বলে চিৎকার শুরু করবে, নয়তো বুদ্ধিমান হলে চুপ থাকবে।
এত দিন অনেকেরই ধারণা ছিল (এমনকি আমারও ছিল) সরকার হেফাজতিদের তোষণের নীতি চালিয়ে যাবে, বন্ধ করবে না। আখেরে সরকার এবং দেশের সমূহ ক্ষতি হবে। পুলিশ যখন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণ দর্শিয়ে হেফাজতের ছোট-বড় নেতাদের ধরতে শুরু করে, তখন আমাদের এই ধারণাটা ভেঙে যায়। বুঝতে পারা যায়, সরকার হেফাজতিদের দমনে সময় নিচ্ছে। তারা যাতে ‘ইসলাম গেল’ ধুয়া তুলে এই গ্রেপ্তারকে ধর্মের ওপর আঘাত বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। সে জন্য সংগত অন্যান্য কারণ দর্শিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে হেফাজত নেতাদের এবং শেষ পর্যন্ত পালের গোদা মামুনুল হককেও গ্রেপ্তার করেছে। সরকারের স্ট্র্যাটেজি এ ব্যাপারে যে অনেকটাই সফল হয়েছে, এটা বলা চলে।
সরকার সরাসরি হেফাজতের সঙ্গে কনফ্রন্টেশনে গেলেও তারা যে খুব একটা মাথা তুলতে পারত তা আমি মনে করি না। হেফাজতের মাসল পাওয়ার ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তবে সরকার গোড়াতেই যদি মামুনুল হক বা অন্য কাউকে ধরত, তাহলে তারা কিছু মাদরাসাছাত্রকে রাস্তায় নামিয়ে ‘ইসলাম গেল’ বা ‘ইসলাম ইন ডেঞ্জার’ ধুয়া তুলে গ্যানজাম সৃষ্টি করতে পারত। জনগণের কিছু অংশ বিভ্রান্ত হতো। সরকার এই ঝুঁকিটাও নেয়নি। কিছু বিভ্রান্ত মাদরাসাছাত্রকে পেটালে পুলিশের সুনাম বাড়ত না। সরকারের এ কৌশলটাকে তাই বাহবা দিই।
বাবুনগরী, মামুনুল হক এবং এজাতীয় কিছু হেফাজত নেতাকে ধরা হলেই হেফাজতি উৎপাত থেকে দেশ মুক্ত হবে তা নয়। জামায়াতের মতো হেফাজতেরও আসল শক্তি মাদরাসা, বিশেষ করে কওমি মাদরাসা। সরকার দেশে যত মাদরাসার সংখ্যা বাড়তে দেবে, ততই জামায়াত ও হেফাজতের সদস্য ও সমর্থকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হারাম। জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে স্বীকার করা হয় না। স্বীকার করতে দেওয়া হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই গরিব ঘর থেকে আসে। ইসলামী শিক্ষাদানের নামে হেফাজতি, জামায়াতি অসাধু রাজনৈতিক শিক্ষা দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয়। এক শ্রেণির মসজিদের খতিবরাও জুমার নামাজের সময় যে খুতবা পাঠ করেন, তা কট্টর ওয়াহাবিজম প্রচার। পবিত্র ইসলাম প্রচার নয়।
হেফাজতিরা সরকারের সঙ্গে তাদের তথাকথিত মৈত্রীর সময় সরকারকে মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার করতে দেয়নি। শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়েছে, দেদার মসজিদ, মাদরাসার সংখ্যা বাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিই। পাকিস্তানে জিহাদিস্টদের সন্ত্রাস যখন দমন করা যাচ্ছিল না, তখন সরকারকে সেনাবাহিনী তলব করতে হয়েছিল। সন্ত্রাসী দমনে রাওয়ালপিন্ডির ঐতিহাসিক লাল মসজিদে (Red Mosque) কামান দাগতে হয়েছিল, ২০ হাজারের ওপর মাদরাসা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারসহ তার সংখ্যা দেদার বাড়ানো বন্ধ করে দিতে হবে। আধুনিক শিক্ষার স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি দুজনেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
এখানে একটি কথা বলা দরকার। কোনো দেশের সমাজে যখন অবক্ষয় দেখা দেয়, তখন সরকারের পক্ষে একা সেই পচন রোধ করা সম্ভব হয় না। দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সেই পতন রোধে এগিয়ে আসে। অনেক বুদ্ধিজীবীকে এই কাজের দায়িত্ব পালন করতে এসে আত্মদানও করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, প্লাবন, এমনকি রাষ্ট্র বিপ্লবেও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যার পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল একটি বড় অংশ। তারা চেয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা দ্বারা দেশটাকে মেধাশূন্য করে রেখে যাবে, যাতে দেশটা স্বাধীন হলেও সমাজ পুনর্গঠনের জন্য কোনো মেধাবী লোক পাওয়া না যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি, স্বৈরাচার শাসন উত্খাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, রাজনৈতিক আন্দোলন কখনো সফল হয় না সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহায়তা ছাড়া। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। আবার রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। বাংলাদেশেও এটাই হয়ে আসছে সব সময়। এরশাদ হটাও আন্দোলন ছিল গোড়ায় সংস্কৃতিসেবীদের। পরে রাজনৈতিক আন্দোলন এরশাদকে সত্যি সত্যি গদিচ্যুত করে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচন জয়ের পেছনে, এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিশাল জয়ের পেছনে ছিল সংস্কৃতিসেবীদের সাহসী ভূমিকা। বাংলাদেশে যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার প্রতিষ্ঠা লাভ তার পেছনে ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষার আন্দোলন, সাহিত্য সংসদ ও ছায়ানটের কম অবদান রয়েছে কি?
দুর্ভাগ্যক্রমে এখন দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী রাজনীতির অভ্যুত্থানের সময় এই লড়াকু সংস্কৃতিসেবীরা নেই। তাদের স্থান দখল করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে মামুনুল হকের মতো অন্ধ মৌলবাদীরা। দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের তৎপরতাও নেই প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতাদানের। তাই দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের এখন ছন্নছাড়া ভাব। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে দেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। তেমনি তাতে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। আমি বিষয়টির দিকে আমাদের সংস্কৃতিসেবী ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখলাম মাত্র।
কলামিস্ট- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী–লন্ডন, সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১