অনলাইন ডেস্ক:
সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে মাদকের জাল ফেলে বসে আছে কারবারি সিন্ডিকেট। ছাত্রনেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মী, দোকানদারসহ ক্যাম্পাসসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘিরেই এই কারবার। কখনো মাদকসেবী হয়ে আবার কখনো বেশি টাকার লোভে এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী। তিন বছর আগে গোয়েন্দা নজরদারিতে দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও আটটি কলেজে ইয়াবা কারবারের সিন্ডিকেট ধরা পড়লে বিশেষ শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। কিছুদিনেই অভিযান স্থবির হয়ে পড়লে কৌশল পাল্টে নেয় কারবারিরা। অনলাইনে ফেসবুক গ্রুপ এবং গোপন যোগাযোগের অ্যাপে এখন চলছে কারবার। শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কারবারিরা সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের সিসা লাউঞ্জে নিয়ে মাদকে আসক্ত করছে। রেস্টুরেন্ট ও বারের আড্ডায় নতুন মাদকের কারবার শুরু হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানের পর করোনা অতিমারির সময়েও এই তিন কৌশলে কারবার চলছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও থেমে নেই কারবার।
গোয়েন্দাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালে অনেক শিক্ষার্থী নতুন করে ঝুঁকে পড়েছে মাদকের কারবারে। এই সুযোগে ইয়াবার সঙ্গে অতিমাত্রার ক্ষতিকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও লাইসার্জিক এসিড ডাইইথালামাইড (এলএসডি) বিক্রি শুরু করেছে চক্র।
সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের নিজের গলায় দা চালিয়ে মৃত্যুর পর তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফেসবুকে ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’ ও ‘আপনার আব্বা’ নামে গ্রুপে যুক্ত কয়েক শ শিক্ষার্থী মাদকচক্রে জড়িত। তাদের অনেকেই এলএসডি সেবন করেছে। সম্প্রতি আইস ধরা পড়লে বেশ কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সন্ধান মেলে, যারা এই মাদক গ্রহণ করেছে। সিসা লাউঞ্জ ও বারের আড্ডা ছাড়াও অনলাইনে রিভিউ দেখিয়ে এসব ভয়ংকর মাদকে আগ্রহী করা হচ্ছে। ডার্কনেটে এসব মাদকের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আফ্রিকান কিছু শিক্ষার্থীও ঢাকায় এসব মাদক আনছে বলে জানায় সূত্র।
ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মাদকের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আগের সেই তালিকা ও অভিযান সম্পর্কে আমি অবহিত নই, কারণ আমি তখন এখানে ছিলাম না। খোঁজখবর নিয়ে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ঢাকা ও কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে আইসের চালান ধরেছি। এলএসডিও প্রথম ধরেছি। এ জাতীয় ভয়ংকর ক্ষতিকর মাদকগুলো যেন দেশে না ছড়াতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে তিন দফায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ডিএনসিকে তালিকা দেওয়া হয় এবং যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তালিকায় ৩৬টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আটটি কলেজের ছাত্র, কর্মী ও প্রশাসনের ৪৬৯ জন ছিল। ওই সময় ডিএনসি যাচাই করে দেখে, তালিকার ২১ জন কারবারে যুক্ত নয় এবং ১৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। ২০১৮ সালে মন্ত্রণালয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদনে ডিএনসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সংশোধনের সুযোগ দিচ্ছে। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১৪ জন ছাত্রনেতার নাম ছিল। ২০১৮ সালে অভিযান শুরু হলে কারবারিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয় এবং অনেকে গাঢাকা দেয়। এরপর কোনো অগ্রগতি নেই। সম্প্রতি সারা দেশের মাদক কারবারিদের তালিকা হালনাগাদ করেছে ডিএনসি। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সেই তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।
ডিএনসি, র্যাব ও ডিবি পুলিশের সূত্রগুলো জানায়, ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই কাফরুলে পাঁচ গ্রাম এলএসডি ও ৪৬টি ব্লটিংসহ ধরা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ইয়াসের রিদোয়ান আনাস। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, অনলাইনে এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি এলএসডির ব্যাপারে জানতে পারেন। পরে কানাডা থেকে বন্ধুর মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। বুধবার ডিবির অভিযানে গ্রেপ্তার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব রুপল ও আসহাব ওয়াদুদ তুর্য এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিন আশরাফ এলএসডি সেবনের চক্র তৈরি করছিলেন। তাঁরা ‘আপনার আব্বা’ নামে ফেসবুক গ্রুপের সদস্যদের প্রলুব্ধ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজ তাঁদের কাছ থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে ঈদের পরদিন ক্যাম্পাসের কার্জন হলে বসেই সেবন করেন বলে তথ্য মিলেছে। পরে ডাব বিক্রেতার দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করে মারা যান হাফিজ। গত এক বছরে রুপল গ্রুপ নেদারল্যান্ডস থেকে সংগ্রহের পর বেশ কিছু ব্লট বিক্রি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, ব্যাংকারসহ প্রতিষ্ঠিত পরিবারের কিছু সন্তান তাদের চক্রে জড়িত। এমন তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানায় ডিবি সূত্র।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঝিগাতলার একটি বাড়িতে হাসিব মুয়াম্মার রশিদ নামে যুবকের আইস তৈরির ল্যাব পায় ডিএনসি। তদন্তে তথ্য মেলে, মালেশিয়ায় সফটওয়্যার ইনঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আইসের ব্যাপারে জানতে পারেন হাসিব। গোপন অনলাইন যোগাযোগে (ডার্কনেট) শুরু করেন আইসের কারবার। তবে ডিএনসির তদন্তে হাসিবের কারবারের দুই প্রান্তে কারা জড়িত তা জানা যায়নি।
২০১৯ সালের ২৭ জুন ভাটারা থেকে আজাহ আনাইওচুকোয়া ওনিয়েনসি নামে এক নাইজেরিয়ানকে ৫২২ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওনিয়েনসি জানান, পার্সেলের মাধ্যমে উগান্ডা থেকে চালান এনে বিক্রির চেষ্টা করেন।’ ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেন, বারিধারার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন কয়েকজন রোগী জানিয়েছেন, তাঁরা ইয়াবার পর আইস সেবন শুরু করেছেন। ধনী পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণরা ডার্কনেট অর্ডার করে পার্সেলে এবং পরিচিতজনের মাধ্যমে আইএস পেয়েছেন।
গত বছরের মে মাসে ‘ওয়েড লাভারস’ নামে ১৫ হাজার সদস্যের একটি ফেসবুক গ্রুপ চিহ্নিত করে দুজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই গ্রুপে প্রকাশ্যে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রির প্রচার চালানো হচ্ছিল। গত ২১ জানুয়ারি উত্তরায় ‘ব্যাম্বো সুইটস রেস্টুরেন্টে’ বিষাক্ত মদ্যপানে অসুস্থ হয়ে পরে মারা যান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফারাহ চৌধুরী ও তাঁর দুই বন্ধু।
জানা গেছে, ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্ত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০২০ সালে চিকিৎসা নেয় ৪৫ জন মাদকাসক্ত। এদের প্রায় অর্ধেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাতা বন্ধুদের ফাঁদে পড়ে মাদক সেবন করেছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রধান উম্মে জান্নাত জানান, শিক্ষার্থী মেয়েরা ফেসবুক, টিকটক, লাইকি থেকে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে গিয়ে লাইভ চ্যাট করে। এই গ্রুপে মদ, ইয়াবা, সিসাবারে পার্টির আয়োজন করে কারবারিচক্র। এসব গ্রুপ থেকে মাদকের হোম ডেলিভারিও দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও চলছে মাদক সেবন। শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপার, কার্জন হল, মল চত্বর, সামাজিক বিজ্ঞান চত্বর, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও নাটমণ্ডল এলাকায় দিন-রাতে অবাধে বসে মাদকের আসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম সার্বক্ষণিক টহল দিলেও থামানো যাচ্ছে না সেবীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় একটা গোষ্ঠী মাদক গ্রহণের সুযোগ নিচ্ছে।