দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসক বা ডিসির মধ্যে ২২ জনই বর্তমান কোনো না কোনো মন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব বা পিএস ছিলেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার সম্প্রতি ৩০ জনকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাতজন মন্ত্রী বা সচিবের পিএস হিসেবে কাজ করেছেন।
বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে সরকারের অধিক আস্থাশীল কর্মকর্তা হিসেবে এঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের ২৪ জন, ২৫ ব্যাচের ২১ জন এবং ২৭ ব্যাচের ১৭ জন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে কর্মরত। এর মধ্যে ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পান।
পিএস থেকে ডিসি হওয়া ২২ কর্মকর্তা হলেন—খুলনায় কৃষিমন্ত্রীর পিএস খন্দকার ইয়াসির, সাতক্ষীরায় পরিকল্পনামন্ত্রীর পিএস মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, পটুয়াখালীতে আইনমন্ত্রীর পিএস নূর কুতুবুল আলম, নওগাঁয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস গোলাম মওলা, নোয়াখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ও পাবনায় মু. আসাদুজ্জামান, চাঁদপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিএস কামরুল হাসান, খাগড়াছড়িতে খাদ্যমন্ত্রীর পিএস মো. সহিদুজ্জামান, মাদারীপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান, বান্দরবানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, কুমিল্লায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পিএস খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান, নাটোরে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর পিএস আবু নাছের ভূঁঞা, বগুড়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর পিএস সাইফুল ইসলাম, যশোরে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর পিএস মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার, সুনামগঞ্জে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর পিএস দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, জামালপুরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ইমরান আহমেদ, ফরিদপুরে পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর পিএস কামরুল হাসান তালুকদার ও ভোলায় আরিফুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিক্ষা উপমন্ত্রীর পিএস শাহগীর আলম, টাঙ্গাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পিএস কায়ছারুল ইসলাম ও নরসিংদীতে আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান এবং রাজশাহীতে জনপ্রশাসন সচিবের পিএস শামীম আহমেদ।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ডিসি নিয়োগে এখানে কোনো পক্ষপাত করা হয়নি। যাঁরা ডিসি হয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ হয়তো অন্য সরকারের সময় হয়েছে। তবে যোগ্যতা অনুযায়ী সেরা কর্মকর্তাদের ডিসি বানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, মন্ত্রীদের পিএস নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। মন্ত্রীদের ইচ্ছামতো পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
মেধাতালিকার হালচাল
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালায় মাঠ প্রশাসনের এই নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা ও মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হয়নি। ডিসি হিসেবে নিয়োগ না পাওয়া ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যাঁরা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ছাত্রজীবনে সরকার দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অভিযোগ আছে, ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা ২৭ ব্যাচের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ, মেধাবী ও ছাত্রজীবনে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৭ ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন মাত্র চারজন। মেধাতালিকায় পেছনে থেকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১৩ জন কর্মকর্তা।
একইভাবে ২৪ ব্যাচের সমিতির দুজন নেতার পরামর্শে বেশির ভাগ ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এই ব্যাচেরও মেধাতালিকায় প্রথম ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন মাত্র চারজন। মেধাতালিকায় পেছনের দিকে থেকে ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন ২১ জন কর্মকর্তা।
২৫ ব্যাচে দুই গ্রুপের নেতাদের পরামর্শে মেধাতালিকায় প্রথমে থাকা ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন সাতজন। মেধাতালিকার পেছন থেকে ডিসি হয়েছেন ১৪ জন।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে এভাবে নিয়োগ হচ্ছে। এর আগের সরকারের আমলেও এমন নিয়োগ হয়েছে। রাজনীতিতে আস্থার সংকট ও বিভাজন যত বাড়ছে, গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তা নিয়োগের মাত্রাও তত বাড়ছে।
বিএনপি সরকারের মন্ত্রীদের পিএসও ডিসি হয়েছিলেন
২০০৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে বিএনপি সরকারের মন্ত্রীদের পিএসদেরও ডিসি করা হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব ড. এম এ মোমেন ২০০৪ সালে ঢাকা জেলার ডিসি ছিলেন। খালেদা জিয়ার বড় বোন ও সাবেক মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হকের পিএস সুরুত জামানকে নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ২০০৫ সালে নিজ জেলা দিনাজপুরের ডিসি করা হয়েছিল। বিএনপি সরকারের মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তাঁর পিএস সি কিউ কে মুস্তাক নারায়ণগঞ্জের ডিসি ছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে এই কর্মকর্তারাই রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকবেন। এ জন্যই আমরা বলেছি, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’ তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তন হলে তখন একটা সুযোগ তৈরি হবে। নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী তখন নতুন কর্মকর্তাদের ডিসি নিয়োগ করা যাবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ডিসি হিসেবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সরকারি কর্মকর্তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁদের নিয়োগ না দিলে সরকারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতো। তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের কর্মকাণ্ড ব্যাহত করার জন্য নানা রকম বিতর্ক তৈরি করছে।